বিয়ের পর বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে সব অতিথি চলে গেছে। ভিড় ছত্রভঙ্গ হতেই নববধূ পুসন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জীবনে প্রথমবার এত বড় আত্মীয় আর বিশাল পরিবার দেখেছে সে। মামাবাড়িতে তার মা-বাবা ছাড়া আর কেউ নেই। ছোটবেলা থেকেই ছোট পরিবারে অভ্যস্ত। হঠাৎ শ্বশুরবাড়িতে দাদিশাশুড়ি, দাদাশ্বশুর, ফুপুশাশুড়ি, ফুপাশ্বশুরের মতো ডজনখানেক সম্পর্কের সঙ্গে দুই-চারটা পরিবার দেখতে পেয়েছে। শ্বশুর-শাশুড়ি, চাচাশ্বশুর, মামাশ্বশুর। বরের বড় বোনের জামাই, ননদ আর ভাই, খালা, মামা, মামি ইত্যাদির বাহিনী দেখে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
পুসনের বর জুলফিকার জানাল, তাদের পুরো পরিবার পৈতৃক গ্রামে বসতি স্থাপন করেছে। মাঝে মাঝে তারা বেড়াতে আসেন। শুনেই আতঙ্কিত পুসন বলল, এ ছোট্ট শহরের ছোট্ট বাড়িতে আমরা ঠিক আছি মা-বাবার সঙ্গে।
জুলফিকার অবাক চোখে পুসনের দিকে তাকাল। তারপর মৃদু হাসল।
দিন যেতে লাগল। কয়েক মাস পর জুলফিকারকে বড় শহরে বদলি করা হয়। পুসনকে নিয়ে নতুন শহরে ভাড়া বাড়িতে এনে উঠল জুলফিকার। প্রতিবেশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু বড় শহরের লোকেরা কীভাবে একসঙ্গে থাকতে হয় তা জানে না। প্রতিবেশীরা তাদের তেমন মূল্য দিল না।
জুলফিকার সকালে অফিসে চলে যায়। সন্ধ্যায় ফেরে। কয়েক সপ্তাহ পর সে পুসনের আচরণে পরিবর্তন লক্ষ করল। পুসনকে প্রায়ই ভীত দেখায়। জুলফিকার কারণ জিজ্ঞেসের পর পুসন বলল, যখন আমি একা থাকি, তখন অনেক ছেলেকে বাড়ির চারপাশে শিস দিয়ে হাঁটতে, হাসতে ও বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়।
জুলফিকার শার্ট গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হলো। কিছু গুণ্ডাপাণ্ডা টাইপ ছেলেকে দৌড়াতে দেখে সে। দুদিন ছুটি নিয়ে বাড়িতেই থাকে জুলফিকার। তার উপস্থিতি টের পেয়ে দুদিন দুর্বৃত্তদের তৎপরতা বন্ধ থাকল। কিন্তু অফিসের দায়িত্বে যোগ দিতেই তারা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। অবশেষে পুসনকে সান্ত্বনা দিয়ে জুলফিকার ঘর বদলানোর কথা ভাবতে শুরু করে। সে নতুন বাড়ি অনেক অন্বেষণ করল। কিন্তু সবই তার বাজেটের বাইরে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাড়ি বদলাতে পারল না।
আর কোনো উপায় না পেয়ে বাড়িতে ডেকে বাবাকে জুলফিকার সমস্যা খুলে বলল। তৃতীয় দিনেই মা ও বাবা বাড়িতে এসে পৌঁছে যায়। প্রতিদিনকার মতো জুলফিকার অফিসে চলে গেল। পুসন খেয়াল করল, এখন বাড়িতে শাশুড়িকে দেখে ওইসব বিপথগামী ছেলে তাদের বাড়ির আশপাশে হাঁটতে বা তাকাতে সাহস করল না।
পাড়ার খোঁজখবর নিয়ে বিকেলেই জুলফিকারের মা প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কী জাদু যে, দুদিনের মধ্যে প্রতিবেশীরা তাদের সঙ্গে খুব মিশে গেল। পুসনের প্রশ্নবিদ্ধ মুখ পড়ার পর, জুলফিকারের মা পুসনকে বললেন, প্রথমে প্রতিবেশীদের তিনি প্রশংসা করেছেন, তাদের কিছু কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এরপর থেকেই প্রতিবেশীর ভেতর আত্মীয়তার অনুভূতি বাড়তে থাকে।
একদিন জুলফিকারের বাবা লোকালয়ের একটা সেলুন থেকে চুল কেটে ফেরার সময় জুলফিকার জিজ্ঞেস করল, বাবা, তোমার চুল তো এমনিতেই খুব ছোট, তাহলে অকারণে সেলুনে যাওয়ার মানে কী?
জুলফিকারের বাবা মুচকি হেসে বললেন, বাবা, সেলুনের লোকদের কাছে পুরো এলাকার খবর আছে। তারা এরকম রেডিও বা নিউজ চ্যানেলের মতো। তাদের সঙ্গে সখ্য বাড়াতে ক্ষতি নেই।
জুলফিকার বাবার কথা ঠিকভাবে বুঝতে পারেনি, কিন্তু যখন বাবা তাকে কাছের মুদি দোকান এবং অন্যান্য দোকানদারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করেন, তখন জুলফিকার বাবার কৌশল বুঝতে পারে। এক সপ্তাহের মধ্যে, কয়েক ডজন দোকানদার জুলফিকারকে চিনতে শুরু করে। দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তারা ‘আসসালামু আলাইকুম ভাইজান’ বলে পরিবারের সবাই ভালো আছেন কি না জিজ্ঞাসা করবে।
এরই মধ্যে জুলফিকারের মা নিজ গ্রামে ফোন করে তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে জুলফিকারের বাড়ির ঠিকানা লিখে দেন। এরপর প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো আত্মীয় তার সঙ্গে দেখা করতে থাকে। কেউ দেশি মুরগির ডিম, হাঁস, কবুতরের লুতা আনে। আবার কেউ এক বস্তা শস্য নিয়ে আসে। জুলফিকারের মা সবাইকে পুসনের সঙ্গে এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দেন, যাতে তারা একে অন্যকে ভালোভাবে চিনতে পারে। জুলফিকারের বাড়িতে অনেক তৎপরতা। বিপথগামী ছেলেদের ঝামেলা চিরতরে এড়ানো হলো।
সবসময় ভিড় এড়িয়ে চলা পুসন এখন পরিবারের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। যখনই জুলফিকারকে আরও বদলি করা হয়, পুসন প্রথমে তার পরিবারের কথা মনে করে। তাদের সঙ্গে নতুন বাড়িতে চলে যায়। সে প্রতিদিন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, যেন সে সর্বদা তার পরিবারের শক্তি ও স্নেহ পায়।
মন্তব্য করুন