

কবিতা সংক্রমিত হয় পাঠক হৃদয়ে। কবির কাব্যমানসে একটি কবিতা যে আলোড়ন তোলে—কবিতায় তা কেমনভাবে প্রকাশিত হতে পারে, তারই সন্নিবেশ ঘটানোর প্রচেষ্টায় এ আয়োজন। প্রথম কবিতাটি পাঠানো হয়েছিল অপর কবিকে। কথা ছিল সেটি পাঠের পর তিনি লিখবেন তার কবিতাটি। খুব বেশি প্রভাবিত হবার বাধ্যবাধকতা নেই, শুধু আবহবদ্ধ করার চেষ্টা। এভাবেই তৃতীয় কবিকে পাঠানো হলো আগের দুটি কবিতা, যথাক্রমে তারপরের কবিরা পেলেন তিনটি, চারটি ও পাঁচটি করে কবিতা। পাওয়া গেল ছয়টি কবিতা। তাই নিয়ে এবারের ‘কবিতার সংক্রমণ’। রচনার ক্রমানুসারে সূচিবদ্ধ কবি—ইরাজ আহমেদ, মহিম সন্ন্যাসী, জুলফিকার হায়দার, সুমন ইউসুফ, জাহিদ সোহাগ ও টোকন ঠাকুর
 
                                                                        
                                                                        
হেমন্তে বৃষ্টি ফিরে আসে
ইরাজ আহমেদ
শহরে চাকরি হারিয়ে আমাদের এই গ্রামে
ফিরে আসে হেমন্তকালের বৃষ্টি।
ডাক্তারখানার বারান্দায় বসে
আমি টের পাই দূরের স্টেশনে
সুগম্ভীর এক ট্রেন তাকে রেখে ফিরে গেল।
এবার হয়তো সে শরীরে জড়িয়ে নেবে
বহুদিন আগে জ্বরের সময়ে ব্যবহৃত সবুজ কম্বল
যাতে আজও লেগে আছে খুব চেনা কারো কাশির শব্দ
অথবা বিকালে হেমন্তের নিঃস্ব লতাগুল্ম ঠেলে
হাভাতে যুবকের মতো মুখ দেবে
ঘাটে একা দাঁড়ানো মেয়েটির নিঃসঙ্গ মেঘের পাত্রে।
বৃষ্টির আঘাতে চারপাশে খসে পড়া পাতারাশি দেখে
আমিও চমকে উঠি—কারা এত মৃত!
হেমন্ত বিষাদ ডেকে আনে ফেনায়িত সদ্যজাত নেশার গেলাসে—
নিঃশ্বাস বন্ধ করে সাপ সরে যায় মানুষের কাছ থেকে—
সরে যায় কাঠের দরজায় আঁকা মাছের ছবি থেকে
নকশা কাটা সেই অসংখ্য নগ্ন মাছের ছবি ভেসে ওঠে রাত্রিবেলা আমার শরীরে।
শহরে চাকরি হারিয়ে হেমন্তে বৃষ্টি আসে এই গ্রামে।
যতদূর জানা যায়,
শহরে মেয়েরা আস্থা হারিয়ে যত্নে তাদের ব্যাগে রাখে
ভীষণ মাত্রার ঘুমের ওষুধ
অথবা তাদের যে কোনো বৃষ্টি শুষে নেয় খবরের কাগজের ব্যবহার।
হেমন্তের বৃষ্টি তুমি যুবক কবির
অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ ছাড়া নিঃসঙ্গ ভূগোলের বই—
ঝরে পড়ো তার ফেনায়িত নেশার গেলাসে।
আমি শুধু টের পাই
উৎসব শেষ হয়ে গেলে তোমাকে দূরের স্টেশনে নামিয়ে
ফিরে যায় ট্রেন—
হয়তো কেউ পাশ ফিরে শুয়ে থাকে মানুষের মতো; নিভে যায় হ্যারিকেন।
 ফুলবারান্দায়
ফুলবারান্দায়
মহিম সন্ন্যাসী
রাত ভিজে গেল, হাসনাহেনার গানও
কার বুকে ভাঙে সুরমা নদীর পাড়
ফুঁসলে উঠেছে সাত্ত্বিক ওরিগানো
জ্বলে উঠে ফের নিভে গেল কারাগার।
প্রমাণিত হলো পুষ্পই অপরাধী
রেণুর ভিতর লুকিয়ে রেখেছে হাওয়া
পুদিনাবাগানে চোখ খুলে রেখে কাঁদি
মৃত্যু মানেই অবশেষে বেঁচে যাওয়া।
অন্ধকারের পুরোনো রেকর্ডারে
আটকে যাচ্ছে ঘ্রাণবিষয়ক কথা
ও কাঠগড়ায় যে যার মতন পারে
দাঁড় করিয়ে রাখছে বিষণ্নতা।
 জীবনবাবুর চশমাটা খুঁজে পেলে নিয়ে নিও
জীবনবাবুর চশমাটা খুঁজে পেলে নিয়ে নিও
জুলফিকার হায়দার
মফস্বল রোদ খচে ট্রেন ধরার দিনেই হারিয়ে গেল জীবনানন্দের উপহার। সেই পুরোনো ধূসর চশমাটা। কোনোদিনই হেমন্ত দেখিনি মনে হয় ওই চোখ ছাড়া। তড়িঘড়ি ট্রেনে ওঠার কালে মায়ের আঁচলগন্ধী কাঁটাতারে ছিটকে গেল চশমাসমেত পুরোটা হেমন্ত। আন্তঃনগর শরীরটা নিয়ে দৌড় লাগাল। তারপর আর হেমন্ত দেখেছি নাকি? নাকি দেখা হয় মৃত চোখে অতীত হলুদ সবুজ?
এরপর যা হয়, সবগুলো পকেট হাতব্যাগ নিংড়ে যেটুকু খুদকুড়া বাঁচে, তাকে গবাদি পশু, সাহিত্যবিশারদরা বলে জাবরকাটা। জাবরের পঙ্ক্তি তাই হতে পারে দুই-এক ফোঁটা। ধরো এক অঘ্রানে বিদ্রোহ করেছিল আমাদের মাঠ-জংলা সব। জোনাকিদের গোপন আতশবাজির পরে ঘাসলতায় শুয়ে মাটির পদ্য শুনছি। ছন্দে মন নেই। ভালো লাগে তবু কুত্রাপির মতো। ভাবছি এমন অন্ধ কেন হয়ে যাচ্ছি। জীবনবাবুর চশমার জন্য লোভ বাড়ে। আমাদের কৈশোর ছিল সত্যিকারের লোভী। রোদ, বিকেল, মেঘ, ঢেউভাঙা ভাটিয়ালি—কতকিছুর লোভ। শেষে তাল নারিকেলের পিছনে রোদ পড়ে গেলে আমরা বিশাল মাঠটাতে তাকাই। ঘোরলাগা চোখে দেখি জয়নুল সুলতানের পেনসিল স্কেচ। শ্যাডোগুলো ভীষণ চোখভেজা নরম। আগুনের অপেক্ষায় ঝিমুচ্ছে যত নাড়া। ইঁদুরের লুকোচুরি হাঁপিয়ে উঠছে। হোগলায় আঙুল চিরে রক্ত বেরোয় আমার। কাদাপানির ডোবাপাড় ধরে আমরা কয়েকটা ভীতু প্রাণ হাঁটতে থাকি সন্ধ্যার দিকে। হাঁটতেই থাকি। কয়েক জনমে ওই হাঁটা মনে হয় যেন শেষ হয় না আর...
 
একটি অরাজনৈতিক
রাজনীতির কবিতা
সুমন ইউসুফ
শীতরাত্রির অপেক্ষা আমাদের চিরায়ত বোন, সুপর্ণা!
বসন্ত একটা ব্যঞ্জনময় ফাঁদ
যার আস্তিনে গোঁটানো থাকে রক্তরাগ, উল্লাস গিলে ফেলা ন্যুব্জসন্ধ্যার মতো অনেক অনেক রাজনৈতিক থুথু কফ। প্রতি সকালে ময়লার গাড়ি বয়ে নিয়ে চলা বালকের শরীরের ঘ্রাণে সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া ধান্ধাবাজ কবি আর দার্শনিকের কলাকৈবল্য-মিলিত স্বর আর সরোজ নিয়ে একটা আদিগন্ত বালনীতি এ অমোঘ বসন্ত!
শীতকাল একটা চিরঅপেক্ষার মতো হলুদ প্রজ্ঞাপন, সুপর্ণা!
বসন্তের মাঞ্জাসুতো একটা মফস্বলের বালকের হাতে চিরকালীন আশার মতো সেঁটে থাকা ব্যাঙ; ছোট ছোট অস্থির ব্যর্থ লাফে মুক্তি না পাওয়া সবুজ।
যে তরুণ বসন্তের কথা বলবে সে সন্দেহজনক
যে তরুণ বসন্তের গান গাইবে সে বিভ্রান্ত
যে তরুণ মিছিল নিয়ে যাবে বসন্ত বসন্ত বলে, সে আজন্ম অশিক্ষিত
যে তরুণ প্রতি হপ্তায় সেমিনার করবে বসন্তের
সে দীর্ঘকাল ধরে মারা খাওয়া
এই পৃথিবীতে যাহা সত্য প্রার্থনার মতো অমোঘ আরাধ্য সুপর্ণা, তা শীত।
ঘরের কোণে, ল্যাম্পপোস্টের নিচে, থানার সামনে, ফুটপাতে জংধরা দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকা নন্দনে কেবল শীতার্ত হাত ছুঁয়ে যাওয়া যে ক্যানভাস; তাহাই নিয়তি-নির্দিষ্ট সকাল আমাদের। আর কোনো তাৎপর্য নাই। ছিলই না কখনো।
যে তরুণ বসন্তের লোভ ও লাভে রক্ত দ্যায় সমাবেশে, রাস্তায়—সে একটা কার্ড। প্রতারিত বালি আর শিশির মিশ্রিত এক পরাবাস্তব কাদা হয়ে যে পড়ে রবে আমাদের আকাঙ্ক্ষার তলায়।
 
আবার শীত
জাহিদ সোহাগ
এই শীত, ধীরে, তোমার কাছে এসে দাঁড়ায়, তুমি ততটা কাতর নও তার হিমে, ঘড়ি দেখলে চটজলদি, যেন বাড়িতে ফিরে এক্ষুনি ইঁদুরের মতো কাটতে বসবে কাজের দিস্তা;
ও কি চেয়েছে কিছু, ওম বা উল?
তার আগেই তোমার রিকশা ছুটে যায় আরও রিকশার প্রহারে;
বাতাসে নবান্নের ঘ্রাণ;
আমার ছিল না তাড়া, জানার প্রশ্নও মৃত, কেবল চেয়ে দেখি ওই শীত, বাড়িয়েছিল হাত, কেন, কে জানে!
আমি ওর আঙুলে, স্বপ্নে, কয়টি গোলাপ এঁকে রাখি;
 
থাকা না-থাকা
টোকন ঠাকুর
ছিল—শব্দটিই বলে দিচ্ছে, নেই। নেই—এই শব্দের মধ্যেই ছিল উঁকি মারে। কী ছিল? কী নেই?
হেমন্ত ছিল মানে হেমন্ত নেই আর। শীত ছিল মানে শীত নেই আর। ট্রেন চলে গেছে মানেই ট্রেন এসেছিল।
বৃষ্টি ছিল। বৃষ্টি নেই। কুয়াশা ছিল। কুয়াশা নেই। একদিন তুমিও ছিলে, নেই হয়ে গেছো।
কিছুই কি থাকে না? কবিতা?
মন্তব্য করুন