হাসান আজিজুল হক
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৩, ০৩:০৭ এএম
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৩, ১১:১৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রথম সাক্ষাতেই তাকে ভালো লেগেছিল

প্রথম সাক্ষাতেই তাকে ভালো লেগেছিল

n হ‍ুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতি জানতে চাই।

কিছু স্মৃতি আছে এবং সেগুলো বলবার মতোই বটে। হ‍ুমায়ূন আহমেদের প্রথম বই ‘নন্দিত নরকে’র কথা আমি বেশ দেরিতেই পেয়েছি। চিরকালই আমি মফস্বলবাসী, কাজেই অন্যান্য কিছুর মতো বইপত্রের খবরাখবরও আমার কাছে একটু দেরিতেই আসত। এ বইটি সম্পর্কে প্রথম আমি জানি আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক আহমদ শরীফের কাছ থেকে। সাহিত্যের ইতিহাসে যার পাণ্ডিত্য অগাধ, তার সাহিত্যবোধও অনেক উচ্চস্তরের। আহমদ শরীফ বইটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তার আলোচনা থেকে জানতে পারি, বাংলাদেশে প্রায় একটা নতুন ধরনের সাহিত্যের উদ্ভব ঘটছে। স্বাভাবিকভাবেই এ সাহিত্যিকের প্রতি আমার খুব আগ্রহ হলো। বইটি সংগ্রহ করার চেষ্টা করলাম এবং বইটি পেয়েও গেলাম। পড়ে দেখলাম, প্রশংসার যোগ্যই বটে। বইটি পড়ে আমার মনে হলো, খুব সাহসী এবং সেইসঙ্গে খুব পরিষ্কার অথচ খুব সংক্ষিপ্ত—এভাবে লেখার ক্ষমতা এ লেখকের আছে। নন্দিত নরকের মতো ছোট্ট উপন্যাসটি পাঠে আমার খুবই বিস্ময় লেগেছিল।

n বাংলা সাহিত্যের এই নতুন ধরনের সাহিত্যের উদ্ভবটাকে আপনি কীভাবে দেখেছেন?

বাংলা সাহিত্য আগে খুব দুর্বল ছিল এমন নয়। যদিও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসটা খুব বেশি পুরোনো নয়, তবু বিশ্বমানের রচনায় বাংলা সাহিত্য পরিপূর্ণ। তবু এরই মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্র; পরবর্তীকালে অন্যান্য যারা আছেন—সতীনাথ ভাদুড়ী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকের যখন আবির্ভাব ঘটেছে তখন এই সাহিত্য আর দীন নয়, নিঃস্ব নয়। এ সমস্তরে পৌঁছানো বা এদের লেখার সঙ্গে আদৌ স্পর্ধা করতে পারে এমন লেখা আমাদের পক্ষে প্রায় অকল্পনীয়ই ছিল। পরবর্তীকালে আমরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে পেয়েছি, পঞ্চকবিদের পেয়েছি। সব মিলিয়ে গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্য একেবারে পূর্ণফসল ভারে নুয়ে পড়ছিল। বিশাল বিশাল ধান্য শীষে ধানগাছ যেমন নুয়ে পড়ে, তেমনি বাংলা সাহিত্যও নুয়ে পড়ছিল ত্রিশের দশকে। সে সময় যে বাংলা সাহিত্যে যেসব রচনা হয়েছে, সে সময়কে সুবর্ণ যুগই বলা চলে। এভাবেই গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলা সাহিত্য পরিপূর্ণতা লাভ করে। আমাদের দেশটা ভাগ হয় এর কাছাকাছি সময়ে, ১৯৪৭ সালে। তখন আমাদের মধ্যে নানা ধরনের দুর্বলতা জন্মায়, এক ধরনের হীনম্মন্যতারও সৃষ্টি হয়। দেশটা ভাগ কেন হয়েছিল তার সব তো আমি বলতে পারি না। দেশ ভাগের পরে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লেখা এখান থেকে বের হয়েছে। যে কোনোভাবেই তিনি বিশ্বমানের লেখকদের সঙ্গে পূর্ণমানে বিবেচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। অন্য লেখক যারা এসেছেন, পরবর্তী সময়ে তারাওবা কম কীসে। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদের মতো কবিদের আবির্ভাবও তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

এমন সব মানুষের সৃষ্ট সাহিত্য সম্ভারের পর যখন হ‍ুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরকের প্রশংসা শুনলাম—বইটি পড়ার পর তার লেখার মধ্য দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের নতুন ধারার যে কথাটি, তাকে আমারও অনেকটাই সত্যি মনে হয়েছে। বিশেষ করে হ‍ুমায়ূনের লেখার ভঙ্গিতে।

n হ‍ুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে আহমদ ছফার কথা বলছিলেন—

আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওই সময়টাতে আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম। তখন আমাদের শিল্প-সাহিত্য জগতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণজন, যার কথায় অনেক সময় আমি একমত হতে না পারলেও কথাগুলো অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, তিনি আহমদ ছফা; আহমদ ছফাই বোধহয় একটু প্রভাব খাটিয়ে খান ব্রাদার্স থেকে হ‍ুমায়ূনের বইটি প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আমার তৃতীয় বই ‘জীবন ঘষে আগুন’ও খান ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়। তার সব কাজ আমি সমর্থন করি বা না করি, তার চিন্তা আমি সমর্থন করি বা না করি, তাকে আমি পছন্দ করতাম। তিনি আমার বইয়ের পাণ্ডুলিপিসহ আমাকে সঙ্গে করে বাংলাবাজার খান ব্রাদার্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর কয়েক দিন আগেই প্রকাশিত হয় ‘নন্দিত নরকে’, বইটি তখনকার যুবসমাজকে আকৃষ্ট করে এবং ধীরে ধীরে আমাদের তরুণ পাঠকদের আইডল হয়ে ওঠে হ‍ুমায়ূন আহমেদ।

n হ‍ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আপনার দেখা হওয়া এবং অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলুন।

তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী লেখিকা সংঘের আমন্ত্রণে এসেছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। হ‍ুমায়ূন আহমেদের ব্যবহার ছিল খুব চমৎকার ও বিনীত। প্রথম সাক্ষাতেই তাকে আমার ভালো লেগেছিল। তারপর একবার নেত্রকোনায় আমরা একসঙ্গে আমন্ত্রিত হলাম। তারপর যেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে, সেখানেই তিনি আমাকে প্রায়োরিটি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রেও তার সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে।

ঢাকায় আমি থাকিনি, প্রয়োজন ছাড়া যাওয়াও হয় না। হয়তো এজন্যই আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়নি। অল্পবিস্তর যে স্মৃতি আমার তার সঙ্গে সেগুলোও ব্যক্তিগত, বলা যায় এসব স্মৃতি অক্ষয় থাকবে। প্রায় অনিরাময় যোগ্য একটা রোগে ভুগে অকালেই চলে গেলেন হ‍ুমায়ূন আহমেদ। এভাবে অকালে চলে যাওয়ায় বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি হয়েছে আমি বলব। কদিন পরেই তার জন্মদিন। আগেও বলেছি এ কথা, আজও বলতে চাই, একটা সত্য স্বীকারোক্তি, গভীর অভিনিবেশ প্রয়োগ করে আমার হ‍ুমায়ূন আহমেদ পড়া হয়নি, তার সমগ্র সাহিত্যও আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। আমার সময় খুব অল্প, জানি না আগামীতে পড়তে পারব কি না।

n হ‍ুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা ও তার লেখা নিয়ে আপনার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই...

প্রথম উপন্যাস থেকেই হ‍ুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয়তা পেয়ে গিয়েছিলেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে লেখক হিসেবে যে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করলেন, বাংলা সাহিত্যে এটা একটা ব্যতিক্রমই বলা যায়। এর আগে কেউই এভাবে পারেননি। আর শুধু জনপ্রিয়ই নন, একটা সময় হ‍ুমায়ূন আহমেদ অবশ্যপাঠ্যই হয়ে ওঠেন; বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের কাছে তার লেখা খুব গৃহীত হয়। এভাবেই চলছিল তার সবকিছু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন হ‍ুমায়ূন, লেখালিখিতে পূর্ণ মনোনিবেশ করার জন্য সেই চাকরিও ছেড়ে দিলেন। তারপর নানান দিকে ছড়িয়ে গেলেন হ‍ুমায়ূন আহমেদ। নিজের লেখা গল্পে টেলিভিশনের জন্য নাটক বানানো শুরু করলেন। আর রাতারাতি তার জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে গেল। হ‍ুমায়ূন আহমেদের লেখা আমি খুব বেশি পড়েছি তা বলব না, কিন্তু পরবর্তীকালে তার কী হয়েছে জানি না; ছোট ছোট করে, মিষ্টি ভাষায়, খুব কৌতুক আবহে লিখতে শুরু করলেন। এককথায় তখন থেকে আমি হ‍ুমায়ূনের লেখা আর পড়ি না। একেবারে পড়িনি এ কথা বলব না, চোখ বুলিয়েছি কিছু কিছু লেখায়। ভাবতে অবাক হই, হ‍ুমায়ূন আহমেদ সিরিয়াস লেখা লিখতে পারতেন, যেমন ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘মাতাল হাওয়া’র মতো লেখা হ‍ুমায়ূন লিখেছেন। ইচ্ছে করলেই দীর্ঘ লেখা তার পক্ষে সম্ভব ছিল। আস্তে আস্তে সাহিত্য থেকে তিনি নানান মিডিয়ায় নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন। নাটক বানাচ্ছেন, সিনেমা বানাচ্ছেন, নিজে ছবিও আঁকছেন। বলা যায়, অজস্র ধারা প্রবাহিত করে দিলেন তিনি।

শ্রুতিলিখন : সঞ্জয় ঘোষ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাড়িভাড়ার কথা বলে ঘরে প্রবেশ, হাত-পা বেঁধে লুটের পর বৃদ্ধাকে হত্যা

লরি উল্টে প্রাইভেটকারের ওপর, নিহত ৪

‘২৪ ঘণ্টা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে সাদা পাথর এলাকা’

তোপের মুখে স্বাধীন খসরু

দুটির বদলে একটি মিষ্টি পেয়ে মন্ত্রীকে ফোন, অতঃপর...

টানা ১০ দিন ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস

জাহান্নামের দরজা শিগগির খুলবে : ইসরায়েল

আ.লীগ কর্মীর বাড়িতে মিলল যুবকের অর্ধগলিত মরদেহ 

ক্রিকেট ইতিহাসে এই রেকর্ড করতে পারেনি আগে কেউ

সিনেমা বানিয়ে তাক লাগাতে চান জয়

১০

জাতীয় দলেও নেই, ক্লাবেও নেই—গারনাচোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার

১১

বৈরী আবহাওয়াও আটকাতে পারেনি তাদের

১২

দেয়াল টপকে সংসদে ঢোকার চেষ্টা, অভিযুক্ত আটক

১৩

উদ্বোধনের পরদিনই ৯২৫ কোটি টাকার সেতু থেকে ল্যাম্পপোস্টের তার চুরি

১৪

বাড়ল আকরিক লোহার দাম 

১৫

মেলবোর্ন স্টেডিয়ামে বিপিএল খেলা পাক ক্রিকেটারের নামে স্ট্যান্ড

১৬

কাঁচা মাছ চিবিয়ে খান তিনি

১৭

যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী বহুমাত্রিক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত

১৮

পারমাণবিক অস্ত্রাগার উন্নত করছে চীন, নেপথ্যে কী?

১৯

কিউবা মিচেল-তপুদের দায়িত্বে আর্জেন্টাইন কোচ

২০
X