

গ্রামটির নাম ডেফলচড়া। পাবনার চাটমোহর পৌর সদর থেকে প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত হান্ডিয়াল ইউনিয়নের এ গ্রামে শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছেন শাঁখারিরা। প্রায় ৩৫টি শাঁখারি পরিবার বাস করেন ডেফলচড়া গ্রামে। এর মধ্যে ২০-২২টি পরিবার শাখা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল।
হিন্দু বিবাহিত নারীরা হাতে যে শাখা পরিধান করেন, সেই শাখা তৈরিই এ গ্রামের শাঁখারিদের প্রধান পেশা। শাখা তৈরি ও বিক্রি করেই চলে তাদের জীবন-জীবিকা।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ শাখা। বিয়ের দিন থেকে স্বামীর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত হিন্দু নারীরা শাখা পরিধান করেন। এটি তাদের সধবার প্রকাশ। পুরুষের পাশাপাশি এ গ্রামের নারীরাও করেন শাখা তৈরির কাজ।
নাটোর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাটা শাখা কিনে এনে পরিষ্কার করে কেটে ছেঁটে পুডিং করেন। এরপর ঘষে ডিজাইন ও ফিনিশিংয়ের কাজ করে বিক্রির উপযোগী করেন। পুরুষরা গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করেন শাখা।
সরেজমিন ডেফলচড়া শাঁখারিপাড়ায় গেলে চোখে পড়ে বাড়িতে বাড়িতে চলছে শাখা তৈরির কাজ। সেখানেই কথা হয় তাদের সঙ্গে। সরোজ সেন নামের এক শাঁখারি জানান, খুলনা থেকে কাটা শাখা কিনে এনে পরিষ্কার করে কেটে ছেঁটে ডিজাইন করে গ্রামগঞ্জে বিক্রি করেন তারা। এটি তাদের পৈতৃক পেশা। ডিজাইন ও মানের উপর নির্ভর করে শাখার দাম। কম দামের প্রতি জোড়া শাখা ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
বাসুদেব নামক আরেক এক শাঁখারি জানান, শত শত বছর তাদের পূর্ব পুরুষরা শাখা তৈরির কাজ করেছেন। এখনো এ পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন তারা। ভারত থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে আসা কাটা শাখা সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও এর আশপাশের এলাকায় ফেরি করে শাখা বিক্রি করেন তারা। প্রতি জোড়া শাখা ৪ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করেন তিনি। এ ব্যবসায় এখন সুবিধা করতে পারছেন না তারা। কোনোমতে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।
অন্যান্য শাঁখারিরা জানান, শাখা শিল্পের উপকরণের দাম বাড়লেও সেই তুলনায় বাড়েনি শাখার দাম। তাই কাঙ্ক্ষিত লাভ করতে পারছেন না তারা। ভালো মান ও ডিজাইনের প্রতি জোড়া শাখা ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এ ব্যবসায় অনেক পুঁজি প্রয়োজন হয়, যা অনেক দরিদ্র শাঁখারির নেই। তাই কেউ কেউ এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছেন, অন্য পেশায়। ডেফলচড়ার শাঁখারিদের সন্তানদের অধিকাংশই এখন আর এ পেশায় আসছেন না।
স্থানীয় ইউপি সদস্য রওশন আলী কালবেলা জানান, অধিকাংশ শাঁখারি পরিবারই ব্যবসায় সুবিধা করতে পারছে না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শত শত বছর সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসা শাঁখারিরা এখন জীবন-জীবিকা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর্থিক দীনতার মধ্যেও এ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।
মন্তব্য করুন