১২ ফেব্রুয়ারি বাংলা কথাসাহিত্যের বিশিষ্ট স্বর শওকত আলীর জন্মদিন। এ উপলক্ষে তাকে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি তার জীবনের শেষ সাত বছর তার কেএম দাস লেনের বাসায় যাতায়াতের দিনগুলোর কথা। আজ যে দিনটির কথা বলছি, তখন তার মনে রাখার শক্তিটা নড়বড়ে। আবার হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায় এমন ঘটনার কথা বলছেন, তা আমারও স্মরণাতীত। আজ সেদিন যেমন বললেন, দেশ ভাগ-পরবর্তী রাজনীতির বিষাক্ত নিঃশ্বাসে পড়ে তার বাবার খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা। বাবার টুকরো টুকরো লাশ কারা যেন ব্যাগে ভরে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল বাড়ির পাশের ফার্মেসির সামনে। বললেন, সেই বহুখণ্ডিত দেহের সঙ্গে থাকা পাঞ্জাবির অবশিষ্টাংশ দেখে সেদিন চিনতে পেরেছিলেন বাবাকে।
দিনাজপুরের যে অংশ দেশ ভাগের সময় হিন্দুস্তানের ভাগে পড়েছিল, সেই রায়গঞ্জে শৈশব কেটেছে শওকত আলীর। বিহারের কাছাকাছি একটা এলাকা। সাতচলিশের আগে-পরে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর স্থানীয় শত্রুদের উপদ্রবে সেখানে আর থাকতে পারছিল না তার পরিবার। শৈশবে মাকে হারিয়েছেন অজানা এক অসুখে। বাবাই তাদের ভাইবোনদের সংসার আগলে রেখেছিলেন। সেই বাবাই বিপদের আশঙ্কায় ছোট ভাইবোনদেরসহ সদ্য ম্যাট্রিকুলেশন পাস করা শওকত আলীকে দিনাজপুরের ট্রেনে তুলে দিয়েছিলেন। সেই ট্রেনে চেপে শওকত আলী বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর শহরে এসে পৌঁছান। তারপর থেকে শওকত আলীর জীবনের ইতিহাস পড়াশোনা, রাজনীতি, লেখালেখি, প্রেম সবকিছু এ দিনাজপুরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।
জিজ্ঞেস করেছিলাম দিনাজপুরের কথা মনে আছে? বললেন, কিছু কিছু। লেখকজীবনের শুরুর দিককার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমি লেখা শুরু করেছি আইএ পাস করার পর। তারও অনেক দিন পর স্থানীয় কিছু কাগজে, এখানে-ওখানে কিছু লেখা ছাপা হয়েছিল। তবে পুরোদস্তুর লেখা আমি শুরু করেছি ষাটের দশকের শুরুতে।
মাঝখানে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’র কথা ওঠায় জানতে চাইলাম—কেন আপনি ইতিহাসের এই অধ্যায়টি নিয়ে উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছিলেন? বললেন, তেমন কোনো ভাবনা থেকে নয়, কিছুদিন আগেই হয়ে যাওয়া ভাষা আন্দোলন ও তার গভীরে লুকিয়ে থাকা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ার আমার লেখক-জীবনকে প্রভাবিত করেছে। এরই একটা বড় প্রমাণ ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। আমি সবসময়ই একটা বিষয় নিয়ে ভাবতাম, পশ্চিমবঙ্গের যারা বাঙালি, তাদের তো ‘আমরা বাঙালি’ বলে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হচ্ছে না! তাদের তো প্রমাণ দিতে হচ্ছে না যে, তারা বাঙালি। তাহলে কেন আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে এই বলে যে, আমরা বাঙালি? কারণ, ওদের সামনে কোনো সংকট নেই। আমাদের ছিল। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের বাঙালি চেতনাটাকেই তখন আঁকড়ে ধরাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। আমি বললাম, সংকটটা এখনো যায়নি, এখনো তা সমানভাবে জরুরি। শওকত আলী নিজ থেকেই বলে উঠলেন, ‘তোমরা করবে’।
বায়ান্নর পর পূর্ববাংলার শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে বাঙালি জাগরণের যে জোয়ার উঠেছিল সেই সামষ্টিক প্রত্যয়ের ব্যক্তিগত অঙ্গীকার নিয়ে শওকত আলী এ বাংলার প্রাকৃত মানুষের জনপদের দিকে যাত্রা করেছিলেন। সে যাত্রাই ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। এ প্রসঙ্গে তিনি আজ আরেকটি কথা বললেন, ‘দেখলাম এ অঞ্চলের ইতিহাসে নেমে এমন কাজ কেউ তো করেনি। এখনো তো কেউ করল না।’
রাজনৈতিক কারণে তাকে জেলও খাটতে হয়েছিল, সে কথা বলতে গিয়ে বললেন, হ্যাঁ। জেলখানায় বসেই পড়াশোনা করতাম। আমার সঙ্গে যে শিক্ষকরা ছিলেন জেলখানায়, তারা আমাকে বই পড়ানোর চেষ্টা করিয়েছিলেন। কিন্তু আমার জন্য যেসব বইপত্র তারা দিয়ে যেতেন সেইসব বইপত্র আমার কাছে পৌঁছাত না। মানে আমার ওয়ার্ডে পৌঁছাত না। আমার পাশে ছিলেন তখন হাজী দানেশ।
শওকত আলীর সঙ্গে বহুবার দেখা হওয়ার স্মৃতিতে যে বিষয়গুলো উনাকে স্মৃতি-বিস্মৃতিতে বারবার উত্থাপন করতে দেখেছি সেদিনও সে বিষয়টির ব্যতিক্রম হলো না। ‘ওয়ারিশ’ উপন্যাসটি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বললেন, আমি তখন থেকে কলেজে চাকরি করছি। ঠাকুরগাঁও কলেজে ছিলাম। পরে ময়মনসিংহ কলেজে পড়ার সময় যে পরিবেশটার মধ্যে আমি বড় হলাম, তখন আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল। তখন তো পাকিস্তান। প্রশ্ন হচ্ছে, এই বাংলা অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যাটা বেশি। মোগল পাঠান যারা এখানে এসেছে। হয়তো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ধরে। তারপর একটা একটা করে জায়গা দখল করতে করতে তারা সিন্ধু দেশ শাসনে বসে পড়ল। বাংলায় এসেছে বখতিয়ার খিলজি এবং তিনি আসেন ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে। প্রায় ৩০০ বছর পর তো ব্রিটিশ শাসন আমল এলো। মুসলমানদের নিয়ে তারা চেয়েছিল আলাদা ভূখণ্ড। তো সে হিসেবে আন্দোলনও হয়েছিল। মুসলমানরা সবাই সেই আন্দোলনে ছিল। একটা পর্যায়ে দেখা গেল, মুসলমান নেতাদের মধ্যে তারা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর তাদের মনে সন্দেহ জাগল যে, কংগ্রেসের নেতৃত্বের মধ্যে ওপরের দিকে তো সবাই হিন্দু। মুসলমান আছে তো নিচের দিকে। তো এটা যদি হিন্দুদের শাসনে চলে যায়, মুসলমানদের কী লাভ হবে? তারা কী পাবে? তাই তাদের মনে প্রশ্ন জাগল। আমার মনে হয়, ব্রিটিশ শাসকরাই তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য এই বুর্জোয়া চিন্তাভাবনা সৃষ্টি করল এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। এটা তখনকার যুগে অনেকে করত এবং এখনো তা চলছে। যাই হোক, মুসলমানদের মনের মধ্যে এ ধরনের ভাব জাগল। তারপর থেকে তারা নিজেদের মধ্যে পার্টি গঠন করল। তারা ভাগ হয়ে গেল। তারা একটা পর্যায়ে এসে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহকে নেতা বানাল। তারপর পাকিস্তান কীভাবে ভাগ হবে, এর সীমারেখা কীভাবে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি নির্ধারিত হলো। ফলে ওই আন্দোলন যখন খুব প্রবল হয়ে উঠেছে, তখন মহাত্মা গান্ধী বললেন, ‘ভারতের মুসলমানরা মুসলিম লীগের এই দাবি সমর্থন করে না।’ ফলে মুসলমানদের মতামত নেওয়ার জন্য তখন একটা নির্বাচনের মতো হয়েছিল। এর নাম ছিল রেফারেন্ডাম। রেফারেন্ডামে দেখা গেল ভারতের মুসলমানদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ পাকিস্তানের দাবি সমর্থন করেছে। বাকিরা করেনি। এর ফলে মহাত্মা গান্ধী নতুন কথা তুললেন—এটা যদি হয় তাহলে ভারতের প্রদেশগুলোকে ভাগ করতে হবে। সিদ্ধান্ত হয় যেসব প্রদেশে হিন্দুর সংখ্যা বেশি তারা ভারতের সঙ্গে থাকবে। আর বাকিরা পাকিস্তানের সঙ্গে যাবে। তখন ওই রেফারেন্ডাম চালু ছিল। তখন পাঞ্জাবে একটি বৈঠক বসল এবং তারা বিভিন্ন অংশ ভাগ করে নিল। বেঙ্গলের পশ্চিম অংশটি পড়ল ভারতের সঙ্গে। বাঙালির এত বড় গণঅধ্যুষিত অঞ্চল কিন্তু সেখানে একটা প্রদেশ তারা দিল না। তারপর একটা ঘটনা জানা গেল। সেটা হচ্ছে এই, তখন তারা চায় না আমরা আলাদা একটি প্রদেশের মালিকানা পাই। স্বভাবত মুসলমানরা। তখন প্রায় ৬০ ভাগ মুসলমান রায় দিল। তবে বাংলার মুসলমানরা শতকরা ৭০ ভাগের বেশি পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন দিল। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানরা সমর্থন দিয়েছিল ১৫ কি ১২ ভাগ। তবে বেলুচিস্তানে ২০ ভাগের বেশি আর পাঞ্জাবে আরও বেশি পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন জানাল। কিন্তু পাঞ্জাবেও ৫০ ভাগ হবে না। ৪৫ ভাগ। ফলে দেখা গেল, পাকিস্তানেও ৫০ ভাগের কম লোক পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন জানাল। তো যেটা করেছে, সেটা করল বাঙালি মুসলমানরা। আসলে পাকিস্তানটা হয়েছে বাঙালি মুসলমানদের জন্য। কিন্তু যে কারণে এতক্ষণ এ কথাগুলো বললাম, তা হলো—পাকিস্তান গঠন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিস্ময়করভাবে এ বাঙালি মুসলমানরাই আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করল। এসব বিষয় নিয়েই আমি লিখেছি।