আফ্রিকার ফুটবল সংক্রান্ত কার্লোস বিলার্দোর ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে যারা একমত ছিলেন না, তারা কাতার বিশ্বকাপ কিংবা প্যারিস অলিম্পিকের পরও হয়তো কাঁধ ঝাঁকিয়েছেন—এগুলো ফ্লুক! আর্জেন্টিনাকে ২-০ গোলে হারিয়ে মরক্কো অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জয়ের পর তারা কিন্তু ঠিকই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য!
যারা নিয়মিত ফুটবলের খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে কার্লোস বিলার্দো অচেনা নন—১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনাদের বিশ্বকাপজয়ী দলের কোচ। ১৯৭৫ সালে আর্জেন্টাইন ক্লাব এস্তাদিয়ান্তেসের কোচ হিসেবে মরক্কোয় একটি প্রতিযোগিতায় খেলতে গিয়েছিলেন এ ভদ্রলোক। দেশটির ফুটবলের হাঁড়ির অবস্থা দেখে এক সাক্ষাৎকারে বিলার্দো বলেছিলেন, ‘ইউরোপ কিংবা আমেরিকা নয়, ফুটবলের ভবিষ্যৎ আফ্রিকা।’ এমন বক্তব্যের পক্ষে যেসব যুক্তি ছিল, তার অন্যতম ছিল, ‘এখানকার শিশুরা এখনো রাস্তায় খেলে।’ সাক্ষাৎকারে বিলার্দো ব্যাখ্যা করেছিলেন—কীভাবে ফুটবল রোম, মিউনিখ কিংবা বুয়েনাস আয়ার্সের রাস্তা থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু আফ্রিকার শহর ও গ্রামগুলোতে খেলা বেঁচে আছে। সেটা খালি পায়ের ফুটবল—গঠনহীন, কাঁচা, বিশৃঙ্খল মাঠের ফুটবল; কিন্তু অসাধারণ। আর্জেন্টাইন সাবেক ফুটবলার বলেছিলেন, ‘যেখানে এভাবে ফুটবলটা খেলা হয়, সেখানেই জন্ম নেয় মহান ফুটবলার, গড়ে ওঠে বড় দল।’
কিছু ফুটবল গল্প ঘটার আগে অনিবার্য বলে মনে হয়। মরক্কোর গল্পটা তেমন নয়—এটা আরও বড় কিছু। এটা এমন এক গল্প, যা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে—কাসাব্লাঙ্কার রাস্তার মাঠ থেকে শুরু করে বিশ্বমঞ্চ পর্যন্ত। এই সাফল্য একদিনে আসেনি। বরং বৃহত্তর ঢেউয়ের অংশ হিসেবে এসেছে। শুরু হয়েছিল ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে ঐতিহাসিক সেমিফাইনাল খেলার মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে প্যারিস অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পদক জয়। সর্বশেষ চিলিতে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জয়। শিরোপা নির্ধারণী লড়াইয়ে ‘আটলাস কাবস’ নামের দলটি আর্জেন্টিনাকে ২-০ গোলে হারিয়েছে। দুটি গোলই হয়েছে ম্যাচের প্রথমার্ধে। গোল দুটি করেছেন ইয়াসির জাবিরি—প্রথমটি ফ্রি কিক থেকে এবং দ্বিতীয় গোল করেন আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগকে চমকে দিয়ে।
দলটি গ্রুপ পর্বে স্পেন ও ব্রাজিলকে হারিয়েছে। শেষ ষোলোয় বিদায় করেছে দক্ষিণ কোরিয়াকে। কোয়ার্টার ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্রকে ৩-১ গোলে হারানোর পর সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে আসে টাইব্রেকারে জয়। এক সময় যে দেশটিকে বিশ্ব ফুটবলে পিছিয়ে থাকা জনপদ হিসেবে দেখা হতো, এখন তাদের এই সাফল্য আর বিস্ময় নয়—এটা এক শক্তিশালী বার্তা। মরক্কোর যুব কাঠামো এমন খেলোয়াড় তৈরি করছে, যারা বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে প্রস্তুত। আর বিলার্দোর বলা সেই রাস্তায় জন্ম নেওয়া সৃজনশীলতা এখন মিশে গেছে বিশ্বমানের অবকাঠামো ও কৌশলগত পরিপক্বতার সঙ্গে।
দিয়েগো প্লাসেন্তের আর্জেন্টিনা দল মরক্কোর বিপক্ষে আক্ষরিক অর্থেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল, যারা মাত্র ৩০ মিনিটেই বিশ্বকাপ ফাইনালকে গুছিয়ে ফেলে; এক ঝটকায় ২-০ ব্যবধানে লিড নেয়। আর্জেন্টিনা এ আসরে নিজেদের প্রমাণ করেছে, ভালো ফুটবল খেলেছে। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের শেষ ছোঁয়াটা দিতে পারেনি। গতি, শক্তি এবং সিদ্ধান্ত—মরক্কো ছিল আফ্রিকান ঘূর্ণিঝড়! যা প্রথমার্ধেই আর্জেন্টিনাকে চাপে ফেলে দেয়। মোহামেদ ওয়াহবির দলের জন্য দ্রুত ট্রানজিশন ছিল ম্যাচের মূল চাবিকাঠি।
দুই গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর প্লাসেন্তে অপেক্ষা করেননি—প্রথমার্ধের আগেই মাতেও সিলভেত্তিকে মাঠে নামান ভ্যালেন্তিনো আকুনার পরিবর্তে। পাঁচজন রক্ষণের কৌশল ভেঙে দলকে পুনর্গঠন করেন। আর্জেন্টিনা ম্যাচের নিয়ন্ত্রণও ফিরে পায়। কয়েকটি আকর্ষণীয় আক্রমণও গড়ে ওঠে। দ্বিতীয়ার্ধে প্লাসেন্তে দল নতুন রূপে সাজান—সান্তিয়াগো ফার্নান্দেজ এবং তোবিয়াস আন্দ্রাদা মাঠে নামেন। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই দৃশ্যপট পরিষ্কার ছিল—আর্জেন্টিনা সর্বাত্মক আক্রমণে যাওয়ার কৌশল নেয়। কিন্তু ফুটবলে এমন দিন আসে, যখন আপনি সবকিছুই করতে পারবেন, শুধু গোলটা ছাড়া। দিনটা সম্ভবত আর্জেন্টিনার জন্য তেমনই ছিল!
মন্তব্য করুন