গণআন্দোলনে ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ মাথায় রেখে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে ‘নতুন বাংলাদেশে’ উত্তরণের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা—দ্রুত দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। দলীয় পরিচয় যেখানে মুখ্য হবে না—এমন এক বাংলাদেশ চান মানুষ। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে সংস্কারের দাবি তাদের। সবার আগে জিনিসপত্রের দাম কমানোর দাবি খেটেখাওয়া মানুষের। দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের নতুন আশায় এ সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে চান সব শ্রেণিপেশার মানুষ। তারা বলছেন, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচিত সরকার দেখার প্রত্যাশাও তাদের।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে থমকে গিয়েছিল পুরো দেশ। নতুন সরকার গঠনের পর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেটে গিয়ে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে জনমনে। সচল হতে শুরু করেছে অর্থনৈতিক কার্যক্রম। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনেও খোলা রাখা হয় অনেক কলকারখানা। সড়কে চলতে দেখা গেছে আন্তঃজেলা বাস-মিনিবাস। বেড়েছে দূরপাল্লার বাস চলাচলও। খুলেছে অধিকাংশ দোকানপাট।
সাধারণ মানুষ বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি চাঁদাবাজি রোধে প্রশাসনের উদ্যোগ প্রয়োজন। তারা বলছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হলে নিত্যপণ্যের দাম অনেকটাই কমে আসবে। এমন কথা বলছেন বাজারের মুদি দোকানিরাও। ছাত্র আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় সুষ্ঠু বিচারসহ প্রশাসন ঢেলে সাজানোর তাগিদ দিচ্ছেন অনেকে। তারা বলছেন, প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত করতে দুর্নীতিবাজদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মাসখানেকের অস্থিরতার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে প্রত্যাশা বেড়েছে জনমনে। এবার তাদের দাবি, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নিতে হবে এই সরকারকে। দীর্ঘদিন ধরে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। সেই পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে দেশ গড়ার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগাতে সঠিক পদক্ষেপের প্রয়োজন দেখছেন সাধারণ মানুষ। ফার্মগেটে ফুটপাতের চা দোকানি মো. সুজন বলেন, ড. ইউনূস ভালো মানুষ। এবার দেশের ভালো হবে। নতুন সরকারের কাছে আমরা চাই দেশকে যেন ভালো রাখে, সন্ত্রাসমুক্ত রাখে। সন্ত্রাসী, রাহাজানি, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি, এগুলো যেন না হয়। আমরা সাধারণ মানুষ যাতে সাধারণভাবে খেয়ে-পরে থাকতে পারি। জিনিসপত্রের দাম যেন কম থাকে।
নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী—এমন প্রশ্নের জবাবে অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের যে চাওয়া, সেই একই চাওয়া। শিক্ষার্থীরা পাঁচটি পয়েন্ট দিয়েছেন—এই দেশ কেমন চাই, শিক্ষাব্যবস্থা কেমন চাই, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন চাই, আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা কেমন চাই এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের যে সংস্কার, সেটা কীভাবে হবে। এই পাঁচটি পয়েন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এই পাঁচটি পয়েন্ট পূর্ণ হয়, তাহলে আমরা বলব এই আন্দোলন সফল হয়েছে।
রিকশাচালক সোহেল হোসেন বলেন, নতুন সরকারের কাছে আমাদের নিরাপত্তা চাচ্ছি। জিনিসপত্রের যে দাম বেড়ে গেছে, তা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই আমাদের গরিবের চাওয়া। রংমিস্ত্রি হাসান মিয়া বলেন, জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। দেশে শান্তি আসুক। আমরা সাধারণ মানুষ যাতে ভালো থাকি, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
মোহাম্মদপুর আসাদ গেটে পত্রিকা বিক্রি করেন শহিদুল হক খন্দকার। অনেকেই পত্রিকা কিনছেন। নেড়েচেড়ে নতুন সরকারের শপথ সংক্রান্ত খবরগুলো দেখছেন। শহিদুল বলেন, নতুন সরকারের কাছে চাওয়া, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা সঠিক পর্যায়ে নিয়ে আসা। সাধারণ জনগণের যে চাওয়া-পাওয়া, সেগুলোকে পূর্ণ করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাখাওয়াত আল আমিন বলেন, উপদেষ্টা পরিষদ তথা ‘নতুন স্বাধীন’ দেশের সরকারকে যদি সেই ‘স্বপ্নের বাংলাদেশ’ বিনির্মাণ করতে হয়, তাহলে এমন কিছু করতে হবে, যার নজির পৃথিবীতেই নেই। একটু এদিক-সেদিক হলেই আবার যা তাই, রাষ্ট্র আবার আগের প্যাভিলিয়নে ফিরে যাবে। প্রতিটি নিষ্ঠুর শাসন বিপ্লব ডেকে আনে, বিপ্লব আবার নিষ্ঠুর শাসন অনিবার্য করে তোলে। আশা করি, আমাদের প্রফেসর সাহেব (ইউনূস) ক্যাপ্টেন হয়ে সেই অসাধ্য সাধন করে দেশকে সঠিক এবং কার্যকর গণতন্ত্রের দিকে ফিরিয়ে আনবেন।
কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী কাজী ফাহমিদা সুলতানা বলেন, তারুণ্যের বিপ্লবে অর্জিত হয়েছে এক অনন্য স্বাধীনতা। দেশ শাসনে সবার অংশগ্রহণ তথা ভোটাধিকার সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবে। আগামীর বাংলাদেশ যেন হয় প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সংবিধানের বিভিন্ন ধারা সংস্কার করার মাধ্যমে আমরা তরুণ প্রজন্ম বিশ্বাস করি, রাজনীতির কালো হাত দূর হবে। যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মাধ্যমে সরকার গঠন করে দেশকে অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে হবে। শিক্ষা কাঠামোকে যুগোপযোগী করে সংস্কার করতে হবে। যেন বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষাপদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শক্তিশালী হবে তারুণ্যের নেতৃত্ব। বাকস্বাধীনতা, স্বৈরশাসনমুক্ত ও বৈষম্যহীন এক বাংলাদেশ পরিচিত হবে বিশ্বের বুকে।
তরুণ লেখক অনুপম দেবাশীষ রায় বলেন, এখন ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তন, শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের জন্য, সংবিধান সংস্কারের জন্য। যাতে করে শেখ হাসিনা যেই কাঠামো দিয়ে স্বৈরাচার হয়ে উঠেছিলেন, সেই অবস্থার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। নতুন করে কেউ যেন স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে। ভবিষ্যতে যেই দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা যেন একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী হতে না পারে। নতুন করে আয়নাঘরের মতো বিভীষিকাময় টর্চার সেল যেন গড়ে না ওঠে। সেজন্য দুবারের বেশি কোনো ব্যক্তি যেন প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন, দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধান যেন একই ব্যক্তি না হন, এর মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। পাশাপাশি সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করা, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা উন্মুক্ত করা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচন থেকে আলাদা করতে সংস্কার প্রয়োজন।
বেসরকারি চাকরিজীবী নাজমুল হাসান বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পর যে সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসবে, তাদের দল যেন কোনো জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। একটি প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে না পারার পরিণাম দেশবাসী এবার প্রত্যক্ষ করেছে। সংবিধানের যেসব অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে দলীয়করণ করা হয়েছিল, সেগুলো সবার আগে সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করতে হবে। আগামীর বাংলাদেশে থাকবে শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থা। কেউ যেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা ও গুজব ছড়াতে না পারে, সেজন্য কাজ করবে একাধিক সাইবার টিম।
মিজান রহমান নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, আগামীর বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের নিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে চুপ থাকার যে সংস্কৃতি, সেটি বন্ধ হতে হবে যে কোনো মূল্যে। সবাই মন খুলে কথা বলবে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর কোনো সংখ্যালঘুর মনে ভীতির সঞ্চার করবে না। জাত-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই পাবে সমান অধিকার। দেশ হবে সাম্যের। আমার ভোটটি যেন আমি দিতে পারি, ভোট জালিয়াতির মতো কোনো বিষয় থাকবে না এ দেশে। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হবে স্বাধীন এবং আইনসভার প্রভাবমুক্ত। সবখানে দলীয় পরিচয় মুখ্য হবে—এমন বাংলাদেশ আর চাই না।