রীতা ভৌমিক
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০৩:০০ এএম
আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জীবনে তাদের ঘোর অমানিশা

আন্দোলনে গিয়ে অঙ্গহানি
জীবনে তাদের ঘোর অমানিশা

মাত্র ১৬ বছর বয়সে এক পা হারিয়েছে পাবনার বেড়া উপজেলার ডোবাখোলা করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র আল আমিন। তার গুলিবিদ্ধ বাঁ পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) পুরুষ ওয়ার্ডে ইউনিট-এ’র ১৪ নম্বর বেড এখন তার ঠিকানা।

বাবার কর্মস্থল ঢাকার মেরুল বাড্ডায় ৩ আগস্ট বেড়াতে এসেছিল আল আমিন। ওই সময় কোটা সংস্কার দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছিল শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের খবর পেয়ে ঘরে বসে থাকতে পারেনি আল আমিন। কারও সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও বাড্ডা এলাকায় ছাত্রদের বিক্ষোভে যোগ দেয়।

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব জাগরণে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। সেদিন দুপুর ২টার দিকে মেরুল বাড্ডায় মিছিলের ওপর টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। পায়ের কাছে একটি শেল পড়ায় হঠাৎ চোখে অন্ধকার দেখে আল আমিন। সেখান থেকে দৌড়াতে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। বাম পায়ে হাঁটুর ওপরে গুলি লাগে। দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও পারে না। ছাত্ররা তাকে সরানোর চেষ্টা করে। পুলিশ তা দেখামাত্র আবার গুলি করতে উদ্যত হয়। ‘পুলিশ সরে গেলে ফিরে আসছি’ বলে সরে যেতে বাধ্য হয় ছাত্ররা। কয়েকজন পুলিশ সদস্য তখন আল আমিনকে লাথি মারে। জ্ঞান হারানোর ভান করে পড়ে থাকে সে। মরে গেছে ভেবে চলে যায় পুলিশ। তার আগে নিয়ে নেয় পকেটে থাকা মোবাইল ফোন আর ১ হাজার ৫০০ টাকা। এরপর ছাত্ররা ফিরে আল আমিনকে উদ্ধার করে। একে একে তিনটি হাসপাতালে গেলেও তাকে ভর্তি করতে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিকেল ৪টার দিকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নাম জানা না থাকায় শিক্ষার্থীরা তাকে ‘রাতুল’ নামে ভর্তি করায়। চিকিৎসকরা জানান, ১০ মিনিটের মধ্যে রক্ত না দিলে ওকে বাঁচানো যাবে না। শিক্ষার্থীরা তখন পাঁচ ব্যাগ রক্ত দিয়ে তাকে বাঁচায়। তবে বাঁ পায়ের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় জীবন বাঁচাতে পরে হাঁটুর ওপর থেকে কেটে বাদ দিতে হয়।

পঙ্গু হাসপাতালে সরেজমিন দেখা যায়, ড্রেসিং করার সময় যন্ত্রণা সইতে না পেরে আল আমিন ‘মা মা’ বলে আর্তনাদ করছিল। তার কষ্টে আশপাশের রোগীর স্বজনদের চোখে পানি চলে আসে।

আল আমিনের মা আছিয়ার কান্না থামছে না। তিনি বলেন, ‘আমার একটাই সাত রাজার ধন। আমার সন্তানের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল।’

শুধু আল আমিন নয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ আরও কয়েকজনের হাত কিংবা পা কেটে বাদ দিতে হয়েছে। পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘এই হাসপাতালে ৮ জনের হাত-পা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। যারা পা হারিয়েছে, তাদের কৃত্রিম পা সংযোজন করা হবে। আর বাকি যারা আহত হয়েছে, তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এখন অস্ত্রোপচার চলছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে আশা করছি।’

এই হাসপাতালের নিচতলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক শেখ সোহানা জানালেন, এখানে ভর্তি গুলিবিদ্ধ ১২২ জনের তালিকা আমাদের কাছে রয়েছে। আহতদের মধ্যে যাদের হাত-পা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের সংখ্যা ৮ থেকে ১০ জন হবে। ডোনারদের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে অপারেশনে আহতদের রক্ত দেওয়া হচ্ছে।’

পঙ্গু হাসপাতাল ছাড়াও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র, গুলিবিদ্ধ হয়ে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়। চিরদিনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন অনেকে।

তাদেরই একজন মো. মনজিল (৫০)। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পুরুষ ওয়ার্ডের ১০২ নম্বর কক্ষের ১৪ নম্বর বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। তিনি মুন্সীগঞ্জে কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। ৪ আগস্ট সকালে মুন্সীগঞ্জ শহরে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সকাল ৯টার দিকে হঠাৎ গুলি শুরু হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ডান হাত, কোমরে, পেটে গুলি লাগে। ডান হাতের কনুইয়ের ওপরের দিকে গুলি ঢুকে মাংস ভেদ করে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে হাড় ভেঙে যায়। আরেকটি গুলিতে পেটের খাদ্যনালি ফুটো হয়ে গেছে। পাঁচটি নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে গেছে। রক্তক্ষরণ হওয়ায় ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালে মনজিলের দেখাশোনা করছেন মেয়ে রূপা। তিনি বলেন, ‘আব্বার ব্যবসা বন্ধ। ভাই বেকার। চিকিৎসায় অনেক খরচ হচ্ছে। ধারদেনা করে চিকিৎসা করছি। কতদিন এভাবে চলবে জানি না। সংসারও অচল হয়ে গেছে।’

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মনজিল আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবেন না। তার আরও অপারেশন করতে হতে পারে।

গত ১৫ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন কমপক্ষে ৭০০ জন। এখনো ভর্তি আছেন ১৯৪ জন। এর মধ্যে আইসিইউতে আছেন ১০ জন। এখানে চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এক চোখ হারিয়েছেন সাতজন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যাদের হাতে বা পায়ে গুলি লেগেছে, তাদের অনেকেরই এসব অঙ্গ হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। একজনের পা অকেজো হয়ে গেছে। তাকে কৃত্রিম পা সংযোজন করা হবে।’

জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটেও একই চিত্র। এখানেও ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে আহত চারজন চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের অবস্থা সংকটাপন্ন।

ইনস্টিটিউটের ক্লিনিক্যাল সার্জারি বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আসমা খান বলেন, ‘এখানে চিকিৎসাধীন রোগীর মধ্যে একজনের হাতের সব আঙুল কেটে বাদ দিতে হয়েছে। বাকি তিনজনের হাত-পায়ে গুলি লেগেছে। তাদের স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।’

আন্দোলনে গিয়ে আঘাত পেয়ে গত ১৫ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চক্ষু পরীক্ষা করিয়েছেন ৭০৬ জন। তাদের মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৫৭৯ জন। অপারেশন করা হয়েছে ৪৮৭ জনের।

হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা জানান, এখনো ৩২ জন ভর্তি আছেন।

এই হাসপাতালের ৪১৫ নম্বর কক্ষের ১৪ নম্বর বেডে শুয়ে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বরিশালের সমন্বয়ক রহমতুল্লাহ সরদার (সাব্বির)। তিনি বরিশাল ল কলেজের ছাত্র। ৪ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে তার বাম চোখে তিনটি গুলি বিদ্ধ হয়। ডান চোখেও আঘাত লাগে। ৫ আগস্ট তাকে বরিশাল থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি বাম চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না।

রহমতুল্লাহ বলেন, ‘সেদিন দুপুর ২টার দিকে খবর পাই বরিশাল সিএনবি রোডে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। আড়াইটার দিকে আরও শিক্ষার্থী নিয়ে সেখানে যাই। পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে আমার চোখে তিনটি গুলি লাগে। মাথার ডান পাশে আঘাত করে। ৫ আগস্ট চিকিৎসক দুটি গুলি বের করেছেন। এখনো একটি গুলি রয়ে গেছে। এখন পর্যবেক্ষণে রয়েছি।’

বড় ভাই নজরুল ইসলাম তার দেখাশোনা করছেন। তিনি জানান, ‘ভাইয়ের জন্য কাজ ফেলে ঢাকায় চলে এসেছি। অনেক কষ্টে ওর চিকিৎসার খরচ চলছে।’

এই হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশিকুর রহমান আকন্দ কালবেলাকে বলেন, ‘বোর্ডের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তার চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়। বাম চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ডান চোখে ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছে। ভবিষ্যতে লো ভিশন ডিভাইস দিয়ে এই চোখে কিছুটা দেখতে পাবে। চিকিৎসার মধ্যে না থাকলে এটি ব্রেনে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এজন্য চিকিৎসার মধ্যে তাকে থাকতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘গুরুতর আঘাতপ্রাপ্তদের স্বাভাবিক দৃষ্টি কোনোদিনই আসবে না। কারণ, অকুলারট্রমা হচ্ছে সবচেয়ে ক্ষতিকর। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা চলবে। অনেকের লো ভিশন ডিভাইস লাগবে।’

আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, ‘আহতদের চিকিৎসার সব দায়িত্ব সরকার নেবে।’

সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ কালবেলাকে বলেন, ‘বৈষম্যমূলক ছাত্র আন্দোলনে যারা আহত হয়েছেন, তাদের সঠিক তালিকা তৈরি করা হবে। তাদের শতভাগ সহযোগিতা করা হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রকাশ্যে এলো কারিনার সৌন্দর্যের গোপন রহস্য

সেনাবাহিনীর অভিযানে ইউপিডিএফ পোস্ট কমান্ডারসহ আটক ২

ঢাকা থেকে আ.লীগের ৭ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার 

মোটরসাইকেল চুরির ২০ দিন পর পাম্পে তেল নিতে এসে ধরা!

ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি পদে নিয়োগ দিচ্ছে প্রাণ গ্রুপ

সর্বকালের সেরা টি-টোয়েন্টি একাদশ বাছাই করলেন সিকান্দার রাজা

নির্বাচনে মাঠ প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা 

সড়ক দুর্ঘটনায় কাতারের ৩ কূটনীতিক নিহত

যেভাবে ধরা পড়লেন প্রেমিকাকে ‘ধর্ষণ’ করা সেই ২ যুবক

জামায়াতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল উপহার পেল ২৬ শিক্ষার্থী

১০

সেনাবাহিনীকে নিয়ে যা বললেন জামায়াত আমির

১১

যমুনা গ্রুপে বড় নিয়োগ

১২

বিশ্বকাপের সময় পরিবর্তনের ইঙ্গিত

১৩

মসজিদে গিয়ে বিপাকে সোনাক্ষী 

১৪

মারা গেলেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী ডায়ান কিটন

১৫

বিয়ে কবে হতে পারে জানালেন ইশরাকের হবু স্ত্রী

১৬

পাকিস্তান-আফগানিস্তান কার সামরিক শক্তি কেমন

১৭

চট্টগ্রাম-৭ আসনে জামায়াতের নতুন প্রার্থীর নাম ঘোষণা

১৮

পাচারকালে ৩৮০ বস্তা সরকারি চাল জব্দ

১৯

গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে এমবাপ্পেকে নিয়ে বড় দুঃসংবাদ

২০
X