রাজশাহী নগরীর তালাইমারী জাহাজঘাট এলাকার ভ্যানচালক রুহুল আমিন। প্রতিদিনের মতো গতকাল শনিবার সকালে ভ্যান নিয়ে বাইরে বের হয়েছিলেন। হঠাৎ অটোরিকশার ধাক্কায় পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর জখম নিয়ে আসেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। আত্মীয়স্বজন জরুরি বিভাগের সামনে রুহুলকে নিয়ে এলে আলী নামের এক ওয়ার্ডবয় একটি ট্রলিতে করে তাকে নিয়ে যায় জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের চেম্বারে। চিকিৎসক রোগীকে দেখে ব্যবস্থাপত্রে ইনজেকশন, ওষুধ আর সিটিস্ক্যানসহ কিছু টেস্ট দেন। রোগীর স্বজনদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ওয়ার্ডবয় আলী নিজেই বাইরের একটি ফার্মেসি থেকে ইনজেকশন ও ওষুধ এনে দেয়। এরপর সিটিস্ক্যান কক্ষের সামনে রোগীকে ট্রলিতে রেখেই ১ হাজার ১০০ টাকা নিয়ে সটকে পড়ে আলী।
আলী টাকা কেন নিয়ে চলে গেল—জানতে চাইলে ভ্যানচালক রুহুল আমিনের ছেলে আল-আমিন প্রতিবেদককে বলেন, ‘ট্রলির জন্য ১০০ টাকা আর ওষুধের দাম নিলো ১ হাজার টাকা। পরে ফার্মেসি থেকে নিয়ে আসা ওষুধের দাম হিসাব করে দেখা গেল মাত্র ৬৫০ টাকার ওষুধ দিয়ে ওয়ার্ডবয় পরিচয় দেওয়া আলী নিয়েছে ১ হাজার টাকা। এভাবে প্রতিদিন রামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা মুমূর্ষু রোগীদের জিম্মি করে ট্রলির মাধ্যমে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় আর আয়াদের অবৈধ ব্যবসা চলে আসছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে ১৮০ জন অস্থায়ী কর্মী ও আয়া দায়িত্ব পালন করেন রামেক হাসপাতালে। তাদের ডিউটি রোস্টারে নিয়োজিত কাজ বাদ দিয়ে এরা পুরো সময় ব্যস্ত থাকে ট্রলি টানতে। আর স্থানীয় হওয়ায় ট্রলিগুলো থাকে এসব কর্মীর হাতেই। ভুক্তভোগীর স্বজনদের অভিযোগ, হাসপাতালের অস্থায়ী কর্মীরা প্রকাশ্যেই এ ট্রলির ভাড়া আদায় করছে জোরপূর্বক। এতে রোগী ও তাদের স্বজনরা সেবার নামে অস্থায়ী কর্মীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। এ নিয়ে রামেকে প্রায়ই ঘটে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। অথচ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, রোগী বহনে হাসপাতালে রয়েছে ৭০টি ট্রলি এবং ২০টি হুইলচেয়ার। তবে এসব ট্রলি কিংবা হুইলচেয়ার ছুঁতে পারেন না রোগী ও তাদের স্বজনরা। প্রত্যেক ট্রলির অপারেটর বনে গেছে হাসপাতালে নিয়োজিত অস্থায়ী কর্মীরা। অথচ হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী, ভর্তিকৃত রোগীর ট্রলি কিংবা হুইলচেয়ারের প্রয়োজন হলে ১০০ টাকা (ফেরতযোগ্য) জমা দিয়ে ১ ঘণ্টার জন্য ফ্রি ট্রলি কিংবা হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু হাসপাতলের এই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিদিন শত শত রোগীর থেকে হাসপাতালের অস্থায়ী কর্মীরা ট্রলি বহনের ২০০-৩০০ টাকা করে আদায় করছে।
আয়নাল হক নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘আমি তো জানি না কত টাকা দিতে হয়। আমার কাছে ১৫০ টাকা চেয়েছে। আমি সেই টাকা দিয়ে ট্রলি নিয়ে দ্রুত রোগীকে ভেতরে নিয়ে এসেছি।’ শুধু তাই নয়; যে ফেরতযোগ্য ১০০ টাকা দিয়ে রোগীর স্বজনরা ট্রলি নিয়ে যাচ্ছে, অনেকেই জানেন না এই ১০০ টাকা তারা ফেরত পাবেন। অনেকেই টাকা দিয়ে ট্রলি ব্যবহারের পর সেই টাকা আর ফেরৎ নিচ্ছেন না।
ট্রলি বুথের দায়িত্বরত আনসারের সহকারী কমান্ডার শিপন বলেন, ‘ট্রলি ফেরতযোগ্য ১০০ টাকার বিনিময়ে ১ ঘণ্টার জন্য ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও রোগীরাও সেটি অনেক সময় বুঝতে পারেন না। আবার হাসপাতালের আয়া কিংবা অস্থায়ী কর্মচারীদের যখন ডিউটি থাকে না, তারা এসব ট্রলি নিয়ে গিয়ে টাকার বিনিময়ে রোগী বহন করে থাকে। তবে এটি কোনো নিয়ম নয়।’ রসিদের মাধ্যমে ১০০ টাকার ফেরতযোগ্য ট্রলি ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করেন এই আনসার সদস্য।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহাম্মদ বলেন, ‘ট্রলি ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। সেই নিয়ম রোগী ও তাদের স্বজনদের জানা উচিত। আমাদের কাছে ট্রলি ব্যবহারে অতিরিক্ত টাকার বিষয়ে অভিযোগ এলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’