ঘন কুয়াশায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে ২০১৪ সালে নয়টি ফেরিতে ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট লাগানো হয়। কিন্তু এ লাইটগুলো স্থাপনের পর থেকেই বিকল থাকায় কোনো কাজে আসছে না। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছেন এ নৌরুটের যাত্রী ও চালকরা। তবে এ সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় বলতে পারেনি বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ। উল্টো দায় চাপাচ্ছে বিআইডব্লিউটিসির কারিগরি বিভাগের ওপর।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করে ৯টি ফেরিতে স্থাপন করা হয় ‘উন্নত প্রযুত্তির ফগ অ্যান্ড সার্চলাইট’। বলা হয়েছিল, এসব লাইট দিয়ে শীতের রাতে ঘন কুয়াশায় চলতে পারবে ফেরি। তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রীর ভাই ছিলেন এই কাজের ঠিকাদার। স্থাপনের কিছুদিন পর থেকেই এ ফগলাইট অকেজো হয়ে পড়ে।
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট শাখা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে চলাচলকারী ফেরি খানজাহান আলী, কেরামত আলী, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, শাহ আমানত শাহসহ নয়টি ফেরিতে এ ফগলাইট বসানো হয়। বলা হয়েছিল, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। অথচ কয়েক দিন পরই অধিকাংশ লাইট নষ্ট হয়ে যায়। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি করেছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। তবে সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট শাখা কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম কালবেলাকে বলেন, ‘ফগলাইট কাজ করে না। ফগলাইটের নামে কিনেছে ভোগাস লাইট। এগুলো কোনো কাজে আসে না। কুয়াশা পড়লে ফেরি নোঙর করা লাগে।’
বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, ঘন কুয়াশায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়ায় নৌরুটে গত শনিবার টানা আড়াই ঘণ্টা ফেরি চলাচল বন্ধ থাকে। একই সঙ্গে আরিচা-কাজিরহাট, জৌকুড়া-নাজিরগঞ্জ নৌরুটে ঘন কুয়াশায় প্রায় টানা চার ঘণ্টা বন্ধ ছিল ফেরি। ফগলাইট স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল ঘন কুয়াশার মধ্যেও ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রাখা। তবে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা এসব ফগলাইট কোনো কাজেই আসছে না।
শনিবার সকালে সরেজমিন গিয়ে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাটে দেখা যায়, ঘন কুয়াশায় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দৌলতদিয়া জিরো পয়েন্ট থেকে মহাসড়কের দীর্ঘ যানবাহনের সৃষ্টি হয়। নদী পারাপারের অপেক্ষায় ছিল যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় পরিবহন।
পণ্যবাহী ট্রাকচালক হাসেম বেপারি বলেন, ‘কুয়াশার মধ্যে ফেরি বন্ধ থাকলে আমরা সঠিক সময়ে গৌন্তব্যে পৌঁছাতে পারি না। ট্রাকে থাকা মালপত্র অনেক সময় ফেরি বন্ধের কারণে নষ্ট হয়ে যায়। এতে আমাদের ও মহাজনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই।’
সিয়াম ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আজ (শনিবার) আমার পরীক্ষা আছে। তাই খুব সকালে দৌলতদিয়া ঘাটে এসেছি; কিন্তু ঘাটে এসেই দেখছি কুয়াশার কারণে ফেরি বন্ধ। এখন কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের এ কষ্টের কথা কে শুনবে? আমরা এর প্রতিকার চাই।’
ফারুক খান নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি কালবেলাকে বলেন, ‘শুধু শুনেছি ফেরিতে ফগলাইট লাগানো হয়েছে। তবে কোনো দিনও দেখিনি কুয়াশার মধ্যে ফেরি চলাচল করছে। এগুলো শুধু নামেই। কোনো কাজ হয়নি। আমরা চাই সঠিকভাবে তদন্ত করে যারা ভুয়া ফগলাইট ফেরিতে লাগিয়েছে, তাদের শাস্তি হোক।’
বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তারা জানান, ফগলাইটের বিষয়ে তারা মন্ত্রণালয়ে অনেকবার জানিয়েছেন। ফগলাইটের সঙ্গে উন্নত রাডার স্থাপন, ইকোসাউন্ড সিস্টেম ও জিপিএস বসানো থাকলে হয়তো ফেরি চলাচল করতে পারত।
ফেরির একাধিক মাস্টার (চালক) কালবেলাকে বলেন, ফেরিতে যে সময় ফগলাইট লাগানো হয়েছিল, ওই সময়ই তা ছিল বিকল। এ কারণে পুরো টাকাটাই জলে গেছে। এরপর কিছু লাইট বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য খুলে নিয়েছেন। কিছু লাইট আছে, যা কোনো কাজের নয়। এখন কুয়াশার কারণে প্রতিদিন মধ্যরাত থেকে দুর্ঘটনা এড়াতে ফেরি বন্ধ রাখতে হচ্ছে। নদীর নাব্য কমে যাওয়ায় নৌরুটের চ্যানেলগুলোও সরু হয়েছে। এ অবস্থায় হালকা কুয়াশায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। ঘন কুয়াশায় মাঝেমধ্যেই ফেরিগুলো দিক হারিয়ে চরে গিয়ে আটকা পড়ছে। এ সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় বলতে পারেনি বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ। তারা দায় চাপাচ্ছে বিআইডব্লিউটিসির কারিগরি বিভাগের ওপর।
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট শাখা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. সালাহউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা শুধু বাণিজ্যিক বিষয়টা দেখি। লাইট স্থাপন, সংযোজন বা বিয়োজনের বিষয়টা দেখে কারিগরি বিভাগ। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কারিগরি বিভাগ ছাড়া সঠিক খবর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে কুয়াশা কেটে গেলে আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে বহরে থাকা ফেরি দিয়ে গাড়ি পারাপার করছি।’
এসব বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি বিআইডব্লিউটিসি পাটুরিয়া ঘাটের ম্যানেজার (মেরিন) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে ইনফরমেশন আপনাকে পরে দেব। কারণ আমি নতুন জয়েন করেছি।’