রাজধানীর ইস্কাটন এলাকার পুরোনো রমনা থানার সামনের সড়ক ও মূল সড়কের সংযোগস্থলে বসানো হয়েছে একটি লোহার খাঁজ। মূল সড়কে ওঠার মুখে এপাশ-ওপাশ করে ফেলে রাখা এই খাঁজটি ‘রিকশা ট্র্যাপার’। চারকোণা লম্বা এই ট্র্যাপারে প্রায় চার আঙুল দূরত্বে বসানো হয়েছে লোহার দণ্ড। দুই লোহার মধ্যবর্তী ফাঁকা অংশে দেওয়া হয়েছে লোহারই তৈরি তীক্ষ্ণ সূচ। কোনো রিকশা এই ট্র্যাপারের ওপর দিয়ে যেতে চাইলে সেটি আটকে যাবে এবং সূচ লেগে ফুটো হয়ে যাবে চাকা। প্রধান সড়কগুলোয় যানজট নিরসনের অংশ হিসেবে রিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনতে এমন পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।
গত শনিবার দুপুরে রাজধানীর ইস্কাটন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেই ট্র্যাপার এড়িয়ে চলছে রিকশা। সোজা না গিয়ে আড়াআড়িভাবে গেলে সহজেই ট্র্যাপার অতিক্রম করতে পারছেন রিকশাচালকরা। কৌশলে ট্র্যাপার অতিক্রিম করে যাওয়া জহিরুল ইসলাম নামে এক রিকশাচালক বলেন, ‘বুদ্ধি থাকলে এই খাঁচাও পার হইতে পারবেন। তবে সাবধানে পার হইতে হইব। চাক্কা আইটকা গেলে প্যাসেঞ্জার (যাত্রী) লইয়া ধাক্কাধাক্কি করন লাগে। পিনে (লোহার সূচ) লাগলে চাক্কা লিক।’
সড়কের সংযোগস্থলে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথের কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী ট্র্যাপার ঘিরে রিকশাচালকদের নানা কাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী। মো. বাবুল নামের একজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘বেশিরভাগ ড্রাইভারই পার হয়া যাইতে পারে। কহনো রিকশা আটকায়া গেলে যাত্রী, ড্রাইভার মিলা ধাক্কা দিয়া বাইর করতে হয়। আমরাও ধাক্কা দিই মাঝেমইধ্যে।’
ট্র্যাপার বসানোর কারণে দিনের বেলা মূল সড়কে আগের তুলনায় রিকশা চলাচল কমেছে। তবে যানজট কমেনি বলে মন্তব্য করেন বাবুল। তিনি বলেন, ‘অফিস, স্কুল শুরু ও ছুটির সময় যানজট আগের মতোই। কারণ, এইডার (ট্র্যাপার) ওপর দিয়া যাওয়ার সময় প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলের গতি কমাইয়া যাইতে হয়। এইহানে গতি কমলে পিছে লম্বা লাইন লাইগা যায়। সমস্যা আর মিটল কই?’
গত শুক্রবার দুপুরে কিছুটা ভিন্ন চিত্র দেখা গেল বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে বসানো ট্র্যাপার ঘিরে। এই ট্র্যাপার পেরিয়ে রিকশা চলাচলের সংখ্যা খুবই কম। তবে এটার পেছনে ট্র্যাপারের থেকে সেখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকাই বেশি। ট্রাফিক পুলিশ তৎপর থাকায় ট্র্যাপারের আশপাশেই ভিড়তে পারছে না কোনো রিকশা। তবে এদিন দুপুরে দেখা যায়, এই ট্র্যাপারের এক পাশের লোহা ভেঙে ওপর দিকে বেঁকে আছে, যা রিকশা বাদে অন্যান্য যান চলাচলের ক্ষেত্রে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। রিকশা চলাচল করতে না পারার কারণে স্বস্তি থাকলেও ট্র্যাপারের এমন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পথচারীরা।
এ সড়কে নিয়মিত চলাচল করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুনায়েদ। তিনি বলেন, ‘রিকশা চলাচল না করলে এ সড়কে একটা স্বস্তি আসে। তবে রিকশা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ফাঁদ (ট্র্যাপার) বসানো হয়েছে সেটির অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে বিপদ। কেউ বেখেয়ালে তীক্ষ্ণ হয়ে থাকা এই লোহার ওপর দিয়ে গেলে তার তো ক্ষতি হয়ে যাবে। আমরা আশা করব, পুলিশ কোনো উদ্যোগ নিয়েই যেন বসে না থাকে। তারা যেন এগুলো দেখভাল করে।’
ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ইস্কাটন, বেইলি রোড ও কাকরাইলের সড়কে পরীক্ষামূলকভাবে মোট পাঁচটি ট্র্যাপার বসানো হয়েছে। নানা প্রতিবন্ধকতা ও পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এই উদ্যোগ। ট্র্যাপারের আকার, ধরনের পরিবর্তন এনে জায়গাভেদে এগুলো বসানো হচ্ছে। যেটা সবথেকে বেশি কাজে দেবে, সেটাকেই পরবর্তী সময়ে নির্ধারণ করে রাজধানীর অন্যান্য সড়কে বসানো হবে।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (ট্রাফিক অ্যাডমিন অ্যান্ড রিসার্চ) মেহেদী হাসান বলেন, ‘যেসব স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে রিকশা ট্র্যাপার বসানো হয়েছে, সেখানে আমরা ভালো সুফল পাচ্ছি। এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে কোন মডেলের রিকশা ট্র্যাপারটা অধিক কার্যকরী, তা নিশ্চিত হওয়ার পরে ঢাকার আরও গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও যেসব সড়কে রিকশা চলাচল নিষেধ, সেসব সড়কে পর্যায়ক্রমে স্থাপন করা হবে।’
যদিও এ ধরনের উদ্যোগকে ‘টোটকা’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে হিতে বিপরীত পরিণতির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। তিনি কালবেলাকে বলেন, শাখা ও মূল সড়কগুলোর মুখে ট্র্যাপার বসিয়ে রিকশা নিয়ন্ত্রণের মতো উদ্যোগটা একটা টোটকা উদ্যোগ। এই উদ্যোগে সাময়িক সুবিধা দেখা যায়, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটা হিতে বিপরীত আকার ধারণ করবে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, প্রবেশমুখে ট্র্যাপার বসানোর ফলে রিকশা বাদে অন্য যানবাহন যখন শাখা সড়ক থেকে মূল সড়কে উঠতে যাবে, তখন সেগুলোর গতি কমাতে হবে। ব্যস্ত সড়কগুলোয় রিকশা বাদেও এ ধরনের অন্যান্য পরিবহনের সংখ্যা কম নয়। এত পরিমাণ পরিবহনের ধীরগতির ফলে আবার যানজটের সৃষ্টি হবে। এতে যানজট কমার বদলে আরও বাড়বে। এ ছাড়া ট্র্যাপার দিয়ে যে রিকশা আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, সেই রিকশাও কোনো না কোনোভাবে এই ফাঁদ এড়িয়ে মূল সড়কে উঠে যাবে। আগেও বিপরীতমুখী ট্রাফিক আটকানোর জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, ঠিক এভাবেই। সেগুলোও রমনাতেই করা হয়েছিল। ওগুলো কিন্তু এখন আর নেই, সব জাদুঘরে চলে গেছে।’
এক্ষেত্রে স্থায়ী সমাধান হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, রিকশার মতো যানবাহনগুলোর ক্ষেত্রে নীতিমালা দরকার। এগুলো সংখ্যায় কেমন হবে, স্ট্যান্ডার্ড কেমন হবে এবং এ ধরনের যানবাহন কোন কোন সড়কে চলতে পারবে, এগুলোর নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। রিকশা যেখানে তৈরি হচ্ছে, সেখানে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, সড়কে নয়।
মন্তব্য করুন