পারিবারিক কলহের জেরে দায়ের করা মামলায় ভোগান্তির শেষ নেই বিচারপ্রার্থীদের। বিচারের জন্য বছরের পর বছর ঘুরতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। পারিবারিক মামলা বিশেষ করে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাগুলো ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা রয়েছে। তবে উচ্চ আদালতের এ নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। পারিবারিক আদালতে কোনো মামলা ৮ থেকে ১০ বছর ধরেও ঝুলতে দেখা গেছে। সারা দেশে পারিবারিক আদালতগুলোর কাঁধে বিচারাধীন ৯০ হাজার মামলার বোঝা। এর মধ্যে ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালতেই ঝুলছে ১৩ হাজার মামলা। ঢাকায় ২৬ বছরে মামলার সংখ্যা বাড়লেও, বাড়েনি আদালত। মামলার চাপে কয়েকমাস পর পর পড়ছে শুনানির তারিখ। শুনানির এ তারিখও তদবির ছাড়া স্বল্প সময়ে মেলে না। আবার তারিখ পড়লেও শুনানি না হওয়ায় ফিরে যেতে হয় বিচারপ্রার্থীদের। এ ভোগান্তির মাঝে নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে পারিবারিক মামলা নিয়ে নতুন অধ্যাদেশ। আদালতে আসার আগে মামলা নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের যেতে হবে লিগ্যাল এইড অফিসে। লিগ্যাল এইড অফিসের পরিধি না বাড়ালে এমন সিদ্ধান্ত ভোগান্তি কমানোর চেয়ে বরং বাড়াবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিচারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন শরীয়তপুরের বাসিন্দা রিমা আক্তার। ২০১৬ সালের ১ জুলাই তার স্বামী মিরাজুল ইসলাম সৌদি আরব যাওয়ার পর রিমা ও তার ছোট মেয়ের ভরণপোষণ বন্ধ করে দেন। তাই ২০১৮ সালে তিনি তার স্বামী মিরাজুলের বিরুদ্ধে দেনমোহর ও ভরণপোষণের দাবিতে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। মামলার পর ২০২২ সালের ২৭ অক্টোবর রিমাকে দেনমোহরের ২ লাখ ৫০ হাজার টাকাসহ তার ও মেয়ের ভরণপোষণ বাবদ মোট ১০ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে রায় দিয়েছিলেন ঢাকার তৃতীয় পারিবারিক আদালত। এ ছাড়া প্রতি মাসে তাদের ৭ হাজার টাকা করে ভরণপোষণ দেওয়ার কথা বলা হয়। এরপর মিরাজুল দেশে এসে মামলা সম্পর্কে অবগত নন মর্মে একটি ‘মিস কেস’ করেন। এ মামলার বিচার এখনো চলছে। দেনমোহর ও ভরণপোষণের টাকার জন্য বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন রিমা ও তার ছোট্ট মেয়ে। রিমা আক্তার কালবেলাকে বলেন, মামলার সাত বছর হয়ে গেল। এখনো আমি আমার বিচার পেলাম না। আগে দুই থেকে তিন মাস পর পর মামলার ডেট দেওয়া হতো। অনেক সময় বিচারক ধার্য তারিখে শুনানি করেন না। কখনো কখনো বিবাদীপক্ষ টাইম পিটিশন দিয়ে মামলা দীর্ঘায়িত করে। তবে এখনো বিচারের আশায় আছি। জানি না কবে আমি আর আমার ছোট্ট মেয়ে বিচার পাব।
২০২১ সালের ৭ নভেম্বর পারিবারিক এক মামলার রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাগুলো ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু তারপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সরেজমিন ঢাকার তিনটি পারিবারিক আদালত ঘুরে দেখা যায়, ছোট্ট এজলাস কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই নথিতে ভরা, এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে আছে। ভেতরে বেঞ্চ সীমিত। ৮ থেকে ১০ জনের বেশি বসার সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বিচারপ্রার্থীদের। আশপাশে নেই কোনো বিশ্রামাগার। এ ছাড়া শৌচাগার সংকট এ কোর্টের দীর্ঘদিনের সমস্যা। তাই বিচারপ্রার্থী বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য চরম ভোগান্তি বয়ে আনছে পারিবারিক মামলা।
কয়েক দশক ধরে পারিবারিক মামলা নিয়ে কাজ করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মলয় সাহা কালবেলাকে বলেন, ২০০০ সালে ঢাকায় পারিবারিক আদালতের সংখ্যা ছিল তিনটি। ২৬ বছর পরও সেই তিনটিই আছে। অথচ এখন মামলা বেড়েছে বহুগুণ। এই ২৬ বছরে নারী ও শিশু আদালত ঢাকায় একটি থেকে এখন ৯টি হয়েছে। অর্থঋণ আদালত চারটি থেকে এখন সাতটি হচ্ছে। সিএমএম কোর্ট বেড়েছে। তাহলে পারিবারিক আদালত বাড়ছে না কেন?
তিনি আরও বলেন, নতুন করে যে অধ্যাদেশ হলো, তাতে পারিবারিক আদালতে আসার আগে মামলা লিগ্যাল এইড অফিসে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এতে মামলায় ভোগান্তি আরও বাড়বে। কারণ, লিগ্যাল এইড অফিসের পরিধি ছোট। যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে পরিধি না বৃদ্ধি করলে তিন কোর্টের সব মামলা একটি অফিসে গেলে ভোগান্তি বাড়বে ছাড়া কমবে না।
মন্তব্য করুন