ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে স্তূপ করে রাখা ১৬ মরদেহের মধ্য থেকে একটি পোড়া হাত বডিব্যাগ ভেদ করে বেরিয়ে আছে। ভিড় ঠেলে সেই পোড়া হাতের কাছে গিয়ে চিৎকার করছিলেন এক বাবা। বলছিলেন, ‘এটাই মোর বেটি মৌসুমির হাত। এই যে ওর হাত। পোড়া যেয়া অনছাই (অঙ্গার) হয়া গেইছে।’ আবদুল মান্নান নামের ওই বাবা বলছিলেন, ‘মেয়েটা মোর মেট্রিক পাস করি ১৪ দিন হইল গার্মেন্টছত কাজে গেছিল। মোর তো সব শ্যাষ হয়া গেল।’
গত মঙ্গলবার রাজধানীর রূপনগরের শিয়ালবাড়ি এলাকায় ‘আর অন গার্মেন্টস’ নামে একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে লাগা ভয়াবহ আগুন নেভানোর পর ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করেন উদ্ধারকর্মীরা। ওই পোশাক কারখানাটিতে কাজ করতেন ২২ বছর বয়সী মৌসুমি খাতুন। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে ওই তরুণী নিখোঁজ থাকলেও গতকাল বুধবার দুপুরের পর তার বাবা আবদুল মান্নান পোড়া হাত দেখে মেয়ের মরদেহ ‘শনাক্ত’ করেন।
মৌসুমির বাবা আবদুল মান্নান পেশায় রিকশাচালক। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় বাড়ি হলেও থাকেন রূপনগরের শিয়ালবাড়ি এলাকায়। কাঁদতে কাঁদতে লালমনিরহাটের স্থানীয় ভাষায় তিনি কথা বলছিলেন। যার অর্থ দাঁড়ায়, তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মৌসুমি দ্বিতীয়। ২০২১ সালে পূর্ব বেজগ্রাম গার্লস স্কুল থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ২ দশমিক ৭২ পেয়ে সে এসএসপি পাস করে। এরপর পড়ালেখার চেষ্টা করলেও দরিদ্র পরিবারে অভাবে তা আর সম্ভব হয়নি। বাবার সংসারে সহায়তা করতে মাসখানেক আগে ঢাকায় এসে বাবার কাছেই ওঠে মৌসুমি। গত ১ অক্টোবর যোগ দেয় ‘আর অন গার্মেন্টস’ নামের পোশাক কারখানায়।
মর্গে মৌসুমির মতো আরেকজনের স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন এক তরুণের পোড়া মরদেহ দেখে। পোড়া মুখ দেখে চিনতে না পেরে ভিড় ঠেলে এক গৃহবধূ নিজেই বডিব্যাগ খুলে দেখতে থাকেন। এরপর শুরু করেন বিলাপ। বলতে থাকেন, ‘এইটাই ইবাদ-মুসার বাবা…’।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মরদেহটি গৃহবধূ ইশরাত জাহান ইমির স্বামী আল মামুনের। তিনি পুড়ে যাওয়া গার্মেন্টেসের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। ঘটনার সময়ে গার্মেন্টস ভবনের তিনতলায় অবস্থান ছিল তার। ইশরাত দুই ছেলে সাত বছর বয়সী ইবাদুর রহমান ইবাদ ও দেড় বছরের মুসাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি বরগুনার আমতলীতে থাকেন। খবর পেয়ে মঙ্গলবার রাতেই ঢাকায় আসেন।
বিলাপ করে ইশরাত বলছিলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে মামুনকে খুঁজছিলেন। শেষ পর্যন্ত মর্গে পেলেন লাশ।
শুধু মৌসুমি বা মামুনের মরদেহই নয়, মর্গে থাকা ১৬ মরদেহের মধ্যে ৯ মরদেহ নিজের স্বজন বলে দাবি করেছে ৯টি পরিবার। এক মরদেহের দাবিদার দুই পরিবার। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত হতভাগা অন্য ৬ জনের কোনো স্বজন আসেননি মর্গে। যদিও প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রূপনগর ট্র্যাজেডির শিকার ১৬ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের পর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। গতকাল থেকে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ মরদেহ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু করেছে।
গতকাল মুক্তা বেগম, খালিদ হাসান রাব্বি, মৌসুমি আক্তার, নাজমুল ইসলাম রিয়াজ, আল মামুন, মাহেরা আক্তার, নুরুল আলম, সানোয়ার হোসেন, রবিউল ইসলাম রবিন এবং জয় মিয়ার মরদেহ শনাক্ত করেন স্বজনরা।
মন্তব্য করুন