

লোকবল সংকটে ধুঁকছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অন্তর্ভুক্ত থানা ও ফাঁড়িগুলো। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অনেক কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্য সিএমপি থেকে বিভিন্ন জেলায় বদলি হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পুলিশ সদস্যদের বদলির পর শূন্যতা পূরণ হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবসরজনিত শূন্যতা। সব মিলিয়ে লোকবল সংকট পূরণ হচ্ছে না। এর প্রভাব পড়ছে থানা ও ফাঁড়ির ওপর। সীমিত লোকবল দিয়ে চলছে থানা ও ফাঁড়ি। চট্টগ্রাম নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা পাহাড়তলী। চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহৎ চক্ষু হাসপাতাল, কলকারখানা, স্কুল, কলেজ এবং সিডিএ মার্কেটসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা এ এলাকায় অবস্থিত। নগরীর অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজারের অবস্থানও এ এলাকায়। তাই প্রায়ই এ এলাকায় নানা ধরনের অঘটন ঘটে। ১৩ দশমিক ৩১ বর্গকিলোমিটারের এ এলাকার নিরাপত্তার জন্য থানায় উপপরিদর্শক (এসআই) থাকার কথা ২৫ জন। তবে বর্তমানে আছেন ১০ জন। সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ও কনস্টেবলও আছেন কম। এতে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। একই চিত্র বাকলিয়া থানারও। এ থানায় এসআই আছেন ১৫ জন। এএসআই ১৫ জন। যদিও গত বছরের ৫ আগস্টের আগে ২৫ জন করে ছিলেন। শুধু এ দুই থানাই নয়, নগরীর প্রায় প্রতিটি থানার অবস্থা একই রকম। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান কাঠামো অনুযায়ী প্রতি ১ হাজার ৪০০ জনের বিপরীতে একজন করে পুলিশ সদস্য থাকার কথা। তবে বাস্তবে এর ধারেকাছেও নেই। যদিও উন্নত বিশ্বে ৩০০ জনের বিপরীতে একজন পুলিশ সদস্য থাকেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, রদবদল, অবসর ও লাইনে সংযুক্তিকরণ ইত্যাদি কারণে শূন্য জায়গা পূরণ হচ্ছে না। এর মধ্যে ছুটিতে গেলে শূন্যতা আরও বাড়ে। বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অনেকেরই সিটিএসবির মতো পুলিশের বিশেষায়িত শাখা পছন্দের। লাইনে সংযুক্ত হতে চাচ্ছেন অনেকে। এরপরও যারা আছেন, তাদের দিয়েই কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
তথ্যমতে, গণঅভ্যুত্থানের পর সিএমপির অনেক সদস্য বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বদলি হয়েছেন। গত দেড় বছরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংগঠনের কর্মসূচি প্রতিহত করতে মাঠপর্যায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে পুলিশের ঘুম হারাম। কেননা যে থানা এলাকায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংগঠনের ঝটিকা মিছিল হবে, সে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার জবাবদিহি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাময়িক প্রত্যাহার হয়ে লাইনে সংযুক্তও হতে পারেন।
জানা গেছে, সিএমপির থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা ঝক্কিঝামেলা মুক্ত থাকতে সিটিএসবি, কাউন্টার টেররিজমসহ পুলিশের অন্যান্য শাখায় বাদলি হতে চাচ্ছেন। পুলিশের বিশেষায়িত এ শাখায় তেমন কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। এরই মধ্যে অনেকে বদলি হয়েছেন। আবার অনেকের আবেদন পাইপলাইনে।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, লোকবল সংকটের কারণে থানা ও ফাঁড়িগুলোয় কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অনেককে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বদলি করা হয়েছে। বদলির পর শূন্যপদ পূরণ হয়নি। আবার বছরের পর এক থানায় চাকরি করার সুবাদে নিয়ম অনুযায়ী নগরের অন্য থানায় বদলি হলে ফের একই থানায় বদলি হয়ে আসেন। এর আগে সিএমপিতে থাকা চাট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলির আদেশ হয়েছিল। সেই ধারায় চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা পুলিশ সদস্যরা সিএমপিতে বদলি হচ্ছেন না।
সিএমপির ঊর্ধ্বতনদের ভাষ্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও উন্নত করতে হলে বেশি জনবল নিয়োগ প্রয়োজন। সরকারি নিয়মে ছয় ঘণ্টা ডিউটির সময়। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করেন। তা ছাড়া ছুটিও তেমন কাটানোর সুযোগ হয় না। থানা ও লাইনে যারা দায়িত্বরত, তারা ছুটিতে গেলে ওই গ্যাপটি শূন্যই থাকে। এ ছাড়া সব পুলিশ সদস্য চুরি, ছিনতাই, নাশকতা, সন্ত্রাস ইত্যাদি দমনে নিযুক্ত থাকেন না। বিভিন্ন সেক্টরে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ লাইন্সে মোট পুলিশ সদস্যের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের মতো। এ সদস্যদের মধ্যে অনেকে আবার ভিআইপি প্রটোকল, দায়রা জজ, বিদেশি অ্যামবাসি, রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন করছেন। যার একটি অংশের চুরি, ছিনতাই, সন্ত্রাস ইত্যাদি দমনে কাজ করা হয় না। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরীক্ষা, খেলাধুলা ইত্যাদিতেও পুলিশের একটি অংশ দায়িত্ব পালন করে। এ অবস্থায় অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত সদস্যদের শূন্য জায়গাটি পূরণ হয় না। তা ছাড়া ৫ আগস্টের পর অনেকেই কাজে যোগদান করেননি, অনেকে পলাতক। পাশাপাশি নিয়মিত বদলি, চাকরি অবসর ইত্যাদির ক্ষেত্রে জায়গাটি শূন্য থেকে যায়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (গণসংযোগ) আমিনুর রশিদ কালবেলাকে বলেন, দেশে মানুষের তুলনায় পুলিশের সংখ্যা নগণ্য। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতিকরণ এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, অপরাধ দমন ইত্যাদিতে পুলিশে জনবল আরও বাড়ানোর ব্যবস্থা সরকারিভাবে করতে হবে। জনবল সংকট হলে পুলিশের যে বিশ্রাম, ছুটি, পরিবারকে সময় দেওয়া ইত্যাদি ঠিকমতো হয় না। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্যই সরকারিভাবে জনবল নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পুলিশের ওপর অর্পিত দায়িত্ব আরও বেগবান হবে। নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।
মন্তব্য করুন