মাহনূর বিনতে হাবীব। বয়স ৫ বছর ৮ মাস। শ্বাসকষ্টে ভর্তি হয়েছে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের ৭০২ নম্বর কেবিনের অ্যালার্জি বিভাগে। সেখানে সময়টা একদম ভালো কাটছে না তার। ডাক্তার এলেই থাকতে হয় ইনজেকশনের ভয়ে। বন্ধুদের জন্যও খুব মন খারাপ তার। মাঝে মধ্যেই মায়ের কাছে আবদার ধরে স্কুলের যাওয়ার জন্য; কিন্তু অসুস্থতার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
মাহনূর ও তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ পরিস্থিতির জন্য তার এলাকার বায়ুদূষণ অনেকাংশে দায়ী। তারা সাধারণত রিকশায় স্কুলে যান। যাওয়া-আসার পথে গাড়ির কালো ধোঁয়া ও প্রচুর ধুলাবালুর মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদের। মাহনূরকে খেলার জন্য রাজধানীর শ্যামলীর ক্লাব মাঠ কিংবা এগ্রিকালচার মাঠে নেওয়া হয়। সেখানেও অনেক ধুলাবালু, যা মাহনূরের সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
এখানেই শেষ নয়, মাহনূর মায়ের গর্ভ থেকেই বায়ুদূষণের শিকার। ২০১৭ সালে সে যখন মায়ের গর্ভে, তখন পাশের বাড়িতে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বাতাসে বালু, সুরকিতে ওদের ঘর ভরে যেত। বালু-সুরকির কণা মায়ের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রবেশ করে ওর শরীরেও প্রভাব ফেলে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
মাহনূরের বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, ধুলার জন্য জানালা খুলতে পারতাম না। এর পরও বারান্দার গ্রিল দিয়ে ধুলা ঘরে ঢুকে যেত। সে যে স্কুলে পড়ে সেখানেও বদ্ধ পরিবেশ। নিচতলায় খেলার জায়গায় যে কার্পেট বিছানো হয়েছে, সেটি পরিষ্কার করা হয় কি না, জানি না। চিকিৎসক ওকে ইনহেলার দিয়েছেন। ধুলাবালু থেকে সাবধান থাকতে বলেছেন।
বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) ২০২২ সালের এক গবেষণায় জানা যায়, ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৪ জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। আদর্শ মাত্রার মধ্যে আছে মাত্র ১০টি জেলার বায়ুর মান। এ অতিরিক্ত বায়ুদূষণের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতাসহ সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। ক্যাপসের গবেষণায় অতিরিক্ত দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৮টি জেলাকে। সর্বোচ্চ বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে গাজীপুরে, এর পরই রয়েছে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জ, যেখানে বায়ুতে অতি ক্ষুদ্রকণার মাত্রা বাংলাদেশের আদর্শ মান প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রামের চাইতে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি। আর বায়ুদূষণের জন্য দায়ী যে অতি ক্ষুদ্রকণা, সেটি আদর্শ মাত্রায় আছে কেবল ১০টি জেলায়। সর্বনিম্ন বায়ুদূষণ পরিমাপ করা হয়েছে মাদারীপুর, পটুয়াখালী ও মেহেরপুরে। এই অতি ক্ষুদ্রকণা বলতে ২ দশমিক ৫ মাইক্রন বা তার কম আকারের বস্তুকণার কথা বলা হয়েছে। এসব জেলার প্রতিটিতে ২ দশমিক ৫ মাইক্রন বা তার কম আকারের ধূলিকণার ব্যাপকতা পরিমাপ করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউ এয়ার’ দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বায়ু কতটুকু নির্মল বা দূষিত, তার তথ্য প্রদান করে। এতে উঠে এসেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দিন দুর্যোগপূর্ণ বায়ুর মধ্যে কাটিয়েছে ঢাকাবাসী। বছরের প্রথম মাসটির মোট ৯ দিন রাজধানীর বায়ুর মান দুর্যোগপূর্ণ ছিল, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বায়ুদূষণে শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রদাহ নিয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের অ্যালার্জি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান কামরুল কালবেলাকে বলেন, পরিত্যক্ত বালি, পাথর, ইটের খোয়া বাতাসে শিশুর শ্বাসনালিতে প্রবেশ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যার অ্যাজমা রয়েছে তার অ্যাজমা দেখা দেয়, শ্বাস বন্ধ হয়ে শ্বাস নিতে সমস্যা হয় অর্থাৎ রেসপিরেটরি ডিসট্রেস হয়। শিশুদের নিমোনিয়া হয়। শিশুর গ্রোথ হয় না। বায়ুদূষণের কারণে অনেক শিশু আক্রান্ত হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট নিয়ে আমাদের কাছে আসে। হাসপাতালে ভর্তির পর তার ডায়ালাইসিসে নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। ওই মেডিকেলে চিকিৎসাধীন মাহনূর বিনতে হাবীবের অ্যালার্জির পক্ষে বেসলাইন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেখানে সিরাম আইজিই হতে হবে স্বাভাবিক ৪৪ থেকে ৬০। ওর এসেছে ৪৬৯। ওর সিরাম ভিটামিন-ডি ৭ দশমিক ৭। স্বাভাবিক ৩০ ওপরে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শিশু কার্ডিওলজির বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, বায়ুদূষণের কারণে শিশু ফুসফুস এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভোগে। গাড়ির কালো ধোঁয়া, শিল্পকলকারখানা এলাকায় যে শিশু বা অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা বসবাস করছেন। তারা বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া সেখানকার যে কোনো ধরনের ধোঁয়া, যেমন আগুন, কয়েল, সিগারেটের ধোঁয়া, এমনকি রান্নাঘরের ধোঁয়াও বাতাসে মিশে বায়ুদূষণ করছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এসব এলাকার শিশুদের হার্ট ফাংশন করছে না। হার্ট এবং ফুসফুসের রক্তচাপ বেড়ে গেছে। কারণ ফুসফুসে যে রক্তনালি রয়েছে এর সঙ্গে হার্টের প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে সম্পর্ক রয়েছে। বাম-ডান উভয় চেম্বারে যোগাযোগ রয়েছে। যে শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের অসুখ থাকে পরে তারা হার্টের অসুখে ভোগেন। ব্রাজিল, নেদারল্যান্ডস, আমেরিকার টেক্সাস, ইংল্যান্ডে বায়ুদুষণের ওপর গবেষণায় উঠে এসেছে, অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা বিরূপ পরিবেশ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়ে যে সন্তান জন্ম দেবেন সেই শিশুর জন্মগত হৃদরোগ, অঙ্গহানি হতে পারে। বাতাসে ক্ষতিকর ভারী পদার্থ সালফার ডাইঅক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস এবং মাইক্রো পার্টিক্যাল বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার নিচে ১০ মাইক্রোর চেয়ে কম কণা বাতাসে মিশে ফুসফুসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে পড়ে। এর প্রভাবে শিশুদের ব্যাপকভাবে ফুসফুসের ক্ষতি হয়। তারা ফুসফুস থেকে পরবর্তীকালে ফুসফুসবাহিত হৃদরোগের শিকার হয়। করপালমনালিক (পিপিএইচ) অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্টের রক্ত চাপ বেড়ে যায়। হার্টের ডান দিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। একসময় পুরো হার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হার্ট ফেইলিওর হয়।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের মূল কারণ শহরের ভেতরে অনেক শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। শিল্প-কলকারখানা এলাকার অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা বায়ুদূষণের কারণে এ ধরনের শিশুর জন্ম দেওয়ার হার বাড়বে। তেজগাঁও, কেরানীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, টঙ্গী, উত্তরা এসব এলাকার অনাগত শিশুরা হৃদরোগের ঝুঁকি নিয়ে জন্ম নিতে পারে। এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে থাকবে। বায়ুদূষণে শিশুর স্বাস্থ্যে যে ক্ষতি হচ্ছে এ নিয়ে সারাবিশ্বে গবেষণা হলেও বাংলাদেশে এ নিয়ে গবেষণা এখনো শুরু হয়নি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণ কমানো না গেলে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে, যার মাসুল দিতে হবে সবাইকে।
মন্তব্য করুন