মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২৯ আশ্বিন ১৪৩২
আরিফিন তুষার, বরিশাল
প্রকাশ : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০২:২৮ এএম
আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৪, ০৮:১৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পটুয়াখালী পৌরসভার উন্নয়ন ৮০০ মিটার এলাকায় সীমাবদ্ধ

পাঁচ বছর অবহেলিত
পটুয়াখালী পৌরসভার উন্নয়ন ৮০০ মিটার এলাকায় সীমাবদ্ধ

দেশের প্রাচীন পৌরসভার একটি হলো পটুয়াখালী পৌরসভা। গত পাঁচ বছর এই পৌরসভার তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। স্থানীয়দের মতে, মহিউদ্দিন আহমেদ মেয়র হওয়ার পর যে দুয়েকটি উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, তা মাত্র ৮০০ মিটার এলাকার মধ্যে হয়েছে। অর্থাৎ একটি সেলফি রোড এবং দুটি লেক ছাড়া এলাকার আর কোনো উন্নয়ন হয়নি। তবে দৃশ্যমান কিছু উন্নয়নের নামে হয়েছে লুটপাট। এক রাস্তা নির্মাণে তিনবার বরাদ্দ, শহীদ মিনার এবং বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণে অনিয়ম, সরকারি কেনাকাটা এবং ঠিকাদারি কাজে দুর্নীতি, হত্যা, জমি-খাল দখল, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে মেয়র মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে।

১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পৌরসভার বর্তমান আয়তন ২৬ বর্গকিলোমিটার। পটুয়াখালী শহরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন সড়ক। কিছুদূর গেলেই চোখে পড়ে আলোচিত সেলফি রোড। এর কাছেই রয়েছে তিনটি কাঠের কালভার্ট, একটি শহীদ মিনার এবং একটি শিশু পার্ক। উন্নয়নের এই ছোঁয়া ৮০০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাকি ৯০ ভাগ সড়ক এবং স্থাপনায় কোনো উন্নয়ন হয়নি। ফলে বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে থাকা আর শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালুতে অতিষ্ঠ পটুয়াখালীর মানুষ। যানবাহন চলাচলে পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।

অভিযোগ উঠেছে, দৃশ্যমান দুয়েকটি উন্নয়ন দেখিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষ অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি বরাদ্দ লুটপাট করেছে। এমনকি অনিয়ম-দুর্নীতির পথ পরিষ্কার রাখতে পৌরসভায় নিজের লোকজন নিয়োগ দিয়ে লুটপাটের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন মেয়র মহিউদ্দিন।

শহরে শহীদ মিনার এবং বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণের নামেও হরিলুট হয়েছে। ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা ব্যয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় শহীদ মিনার ছাড়াও একটি জাদুঘর এবং রেস্টুরেন্ট করার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে শহীদ মিনার ছাড়া আর কিছু হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণে বরাদ্দের ২ কোটি টাকা নিজের ব্যাংক হিসাব নম্বরে গচ্ছিত রাখেন মেয়র মহিউদ্দিন। এ নিয়ে সমালোচনার মুখে ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ম্যুরাল নির্মাণ করান তিনি। কিন্তু নির্মাণে অনিয়ম নিয়ে স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়েন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। পরে ম্যুরালটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হয়।

প্রতি বছর পৌরসভায় ৮ কোটি টাকার কাগজপত্রসহ স্টেশনারি মালপত্রের প্রয়োজন হয়। সবশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে দরপত্রের মাধ্যমে প্রিন্টিং এবং স্টেশনারি মালপত্র কেনা হয়। এরপর থেকে দরপত্র ছাড়াই কেনা হচ্ছে মালপত্র। পৌরসভার তিতাস মোড় থেকে রুস্তম হাওলাদারের কালভার্ট পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণে তিনবার প্রকল্প গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ৪ কোটি টাকার বালু ভরাট, ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং সবশেষ ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনর্নির্মাণ ও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।

পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডাক্তার শফিকুল ইসলাম জানান, গত পাঁচ বছরে ৮০ ভাগ রাস্তাঘাটের কোনো উন্নয়ন হয়নি। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা।

পটুয়াখালী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী আজিম উদ্দিন আরজু জানান, গত ৫ বছরে ৯০ কিলোমিটার রাস্তার উন্নয়নে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কিছু কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ আগামী ৩ মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ জানান, গত ৫ বছরে ১৮০ কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে। সব উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করতে আড়াই থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।

ব্যাংক ড্রাফট জালিয়াতি: পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী আরজু মেয়রের অত্যন্ত কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। একই প্রজেক্টকে বিভিন্ন দপ্তরের কাজ দেখিয়ে বিল আদায়ে সব ধরনের সহায়তা করেন এই আরজু। মেয়র মহিউদ্দিনের মেয়াদকালের প্রথম চার বছরে যত কনস্ট্রাকশনের কাজ হয়েছে তার মধ্যে ১৩২ কোটি টাকার ব্যাংক ড্রাফটই ছিল ভুয়া। যার মামলা এখনো চলমান। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকায় পদ্মা ব্যাংকের ম্যানেজারসহ ৯ জন চাকরিচ্যুত হন।

কচুরিপানা পরিষ্কারে ব্যয় ৭ কোটি টাকা: পৌরসভার ড্রেনেজ ও খাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বেতনভুক্ত কর্মী রয়েছেন। যাদের বেতন প্রতি মাসে প্রায় ১৯ লাখ টাকা। এর বাইরে শহরে কচুরিপানা পরিষ্কারের নামে সুপারভাইজার ইউসুফ এবং হারুনর রশিদের মাধ্যমে আলাদা বিল করে প্রতি মাসে ১২ লাখ টাকা উঠানো হয়। যদিও পৌর এলাকায় কচুরিপানার কোনো অস্তিত্বই নেই। এই অপকর্মে সহায়তা করছে পৌরসভার হিসাবরক্ষক কামরুজ্জামান বুলবুল।

মশকনিধন ও কম্বল বিতরণে হরিলুট: মশকনিধন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতি বছর হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ৭২ লাখ টাকা। যদিও কোনো প্রকার মশকনিধন কার্যক্রম হয় না। অথচ মশার অত্যাচারে নগরীর মানুষ অতিষ্ঠ। এদিকে প্রতি বছর শীতার্তদের জন্য ৬০ লাখ টাকার কম্বল ক্রয় দেখানো হয়। কিন্তু বিতরণ করা হয় মাত্র দুই থেকে তিনশ কম্বল। তাও খুবই নিম্নমানের। পৌরসভার তহবিল থেকে দুস্থদের মধ্যে প্রতি মাসে ২ লাখ টাকা, বছরে ২৪ লাখ টাকা সহায়তার হিসাব দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এই টাকা প্রকৃত দরিদ্ররা পায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।

দোকান বরাদ্দে স্বজনপ্রীতি: শহরের পৌর নিউমাকের্ট বাজারে দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রেও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে মেয়রের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মেয়র মহিউদ্দিন ও তার বন্ধু হাফিজুর রহমান লোকজন নিয়ে শহরের পৌর নিউমাকের্ট বাজারে কিচেন মার্কেট করার ঘোষণা দিয়ে সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে মৌখিক নির্দেশ দেন। ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে আপত্তি জানান। কিন্তু ওই বছরের ৬ অক্টোবর রাতে মার্কেটে আগুন লাগে। এতে বাজারের শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আংশিক ও সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। এ বিষয়ে পটুয়াখালী শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. এনায়েত হোসেন বলেন, শহরের পৌর নিউমাকের্ট বাজারে আমার ওষুধের দোকান ছিল। কিন্তু আগুনে ২০২১ সালে নিউমার্কেট বাজারের আমার দোকান পুড়ে যায়। কিন্তু মেয়র আমাকে সেখানে দোকান বরাদ্দ দেয়নি। অথচ নামে-বেনামে দোকান পেয়েছেন মেয়রের চাচাতো ভাই, ভাতিজা, জেলা যুবলীগ সভাপতি ও কাছের লোকজন। পৌর পরিষদের ১২ জন কাউন্সিলর দোকান পেয়েছেন। এর বাইরে দৌড়ঝাঁপ করে যারা দোকান পেয়েছেন তাদের গুনতে হয়েছে নির্মাণ ব্যয়ের তিনগুণ বেশি টাকা।

খালের ওপর বাসভবন: অভিযোগ উঠেছে, পৌরসভার আওতাধীন এলাকার নদী-খাল-জলাধার রক্ষার দায়িত্ব যার, তিনিই এসব দখল করে বসে আছেন। ফৌজদারি খালের ওপর মেয়র নির্মাণ করেছেন বহুতল ভবন, যা এলাকায় টাইটানিক নামে পরিচিত। ওই এলাকার নদীও তারই দখলে। জানা যায়, নদী রক্ষা কমিশন নদী ও খাল দূষণ বন্ধ এবং নদী ও খাল থেকে মেয়রের বাসভবনসহ সব স্থাপনা সরাতে নির্দেশ দিলেও মেয়র তাতে কর্ণপাত করেননি। পরে ১৫ দিন সময় দিয়ে এসব সরানোর নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেওয়া হয় মেয়রকে। তিনি তাতেও কর্ণপাত করেননি। এরপর গত বছরের ১৪ মে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

আদালতের নির্দেশ অমান্য: মার্কেটে দোকান বরাদ্দ নিয়ে করা এক মামলায় আদালতে হাজির হন মেয়র মহিউদ্দিন। আদালতে তিনি ব্যবসায়ীদের দোকান বরাদ্দ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, দোকান বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রাধিকার এবং জমাকৃত অগ্রিম জামানত নতুন সালামির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। অথচ মেয়রের কাছে দোকানের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘হাইকোর্টে গেছো, এখন হাইকোর্ট ঘর দেবেন, আমার কাছে কোনো ঘর নাই।’ মামলার বাদী রফিক গাজী বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পর মেয়রের ডাকে ব্যবসায়ীরা পৌরসভায় যান। এরপর মেয়র লোকজনের স্বাক্ষর নেন। পরে ওই স্বাক্ষর জাল-জালিয়াতির করে মেয়র আদালতে উপস্থাপন করেন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, পটুয়াখালী পৌরসভা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কিচেন মার্কেট নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখনো শেষ হয়নি।

হত্যার অভিযোগ: জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী পটুয়াখালী পৌরসভার সুতাখালী খাল দেখতে যান এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। তখন খাল রক্ষার দাবি নিয়ে এগিয়ে আসেন বৃদ্ধ মো. মাকসুদুর রহমান তালুকদার। মেয়র সেখানেই তাকে হুমকি দেন। কিছুদিন পর শ্মশানে দাহ করার স্লাবের নিচ থেকে ওই বৃদ্ধকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ সময় দাহ করার জন্য রাখা কাঠ তার শরীরের ওপর ছিটানো ছিল। পরে তাকে পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের বড় মেয়ে মাকসুদা আক্তার মিশু বলেন, বাবার মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি ঢাকা থেকে আসি। ততক্ষণে লাশ দাফন হয়ে যায়। আমাকে জানানো হয়, আমার বাবা স্ট্রোক করেছিল। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাবার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তিনি দাবি করেন, তার বাবাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মেয়রের লোকজন আমাদের বাসায় এসে হুমকি দিচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অবশেষে বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে গাজা শান্তিচুক্তি সই

জয়পুরহাট জেলা এনসিপির প্রধান সমন্বয়কের পদত্যাগ

শরীয়তপুরে নির্যাতিত শিশুর পাশে তারেক রহমান

‘ড. তোফায়েলের শূন্যতা বহু দশক অনুভূত হবে’

আওয়ামী লীগ নেত্রী কেকার মরদেহ উদ্ধার

স্থানীয় সমস্যা সমাধানের আশ্বাস আনোয়ারুজ্জামানের

পূজা পরিষদ ও মহানগর কমিটির প্রত্যাশা / সংকট সমাধানে এক হয়ে কাজ করার নজির অব্যাহত থাকুক

নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে : পিএনপি

শেষ ওভারের নাটকীয়তায় প্রোটিয়াদের কাছে বাংলাদেশের হার

নিষিদ্ধ হওয়া ভিডিও নির্মাতাদের সুখবর দিল ইউটিউব

১০

জাতিসংঘের ৮০তম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে জামায়াতের অংশগ্রহণ

১১

‘ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াও আমাদের দিনে দাঁড়াতে পারবে না’ 

১২

রিপন মিয়াকে প্রাণনাশের হুমকি

১৩

ঢাবি সাদা দলের বিবৃতি / এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ অপ্রত্যাশিত

১৪

৪৮ জেলার ৪৩৫ স্পটে হত্যাকাণ্ড ঘটায় পুলিশ-যুবলীগ : তাজুল ইসলাম

১৫

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল জামায়াত নেতার

১৬

ইয়ামালের জন্য আল হিলালের ৫২৬০ কোটি টাকার প্রস্তাব!

১৭

অতিরিক্ত সিম স্বেচ্ছায় বাতিল না করলে যা করবে বিটিআরসি

১৮

‘দ্বাদশ ব্যক্তি’ হামজাদের প্রতিপক্ষ

১৯

জনগণের আমানত রক্ষায় জমিয়ত সর্বদা সচেষ্ট থাকবে : মোহাম্মদ আলী

২০
X