এক বছর আগে আজকের এই দিনে (৭ মার্চ) গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণ হারান ২৬ জন। এ ঘটনায় বংশাল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়। পরবর্তী সময়ে মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) বোম ডিসপোজাল ইউনিট। ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে ওই ভবনের নিচে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে জানা যায়। এ ক্ষেত্রে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের গাফিলতির বিষয়টিও সামনে উঠে আসে। তবে মামলার তদন্তে তিতাসের অসহযোগিতার কারণে এখন পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। এই মামলায় ভবন মালিকসহ ৩ জন গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঘটনায় তাদের দায় খুঁজে পায় তদন্ত কমিটি। তবে তারা বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
তদন্ত সূত্র জানায়, সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনার মামলায় গ্রেপ্তার ভবনটির মালিক দুই সহোদর মো. ওয়াহিদুর রহমান (৪৬), মতিউর রহমান (৩৫) এবং ওই ভবনের একটি স্যানিটারি দোকানের মালিক আ. মোতালেব মিন্টুর অবহেলার বিষয়টি পাওয়া গেছে। বিল্ডিং কোড না মেনেই ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল। অননুমোদিত থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে বেজমেন্টে দোকান ভাড়া দিয়েছে মালিকপক্ষ। অথচ সেখানে থাকার কথা ছিল পার্কিং। আর ওই বেজমেন্টে অবৈধভাবে স্যানিটারির দোকান ভাড়া নিয়েছেন মিন্টু। তিনি অবৈধভাবে দোকান ভাড়া নেওয়ার পাশাপাশি সেখানে এসি লাগিয়ে কাচ দিয়ে পুরো বেজমেন্ট আবদ্ধ করে রেখেছিলেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ভবনটি বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করা হয়। সেগুলো সিটিটিসির ফরেনসিক ল্যাব, সিআইডির ফরেনসিক ল্যাব, বিস্ফোরক পরিদপ্তর সব জায়গায় পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব আলামত পরীক্ষা করে কোনো বিস্ফোরকের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। বিস্ফোরণটা হয়েছে গ্যাস থেকেই। এ ঘটনায় তিতাস কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাব এবং গাফিলতি রয়েছে। আবাসিক ভবনে গ্যাসের রাইজার মাটির ওপরে থাকে। কিন্তু ওই ভবনে ছিল মাটির নিচে। তদন্তকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে এই জিনিস দেখার পর আদালতের অনুমতি নিয়ে সিটিটিসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে মাটি খুঁড়ে গ্যাসের লাইনটি বিচ্ছিন্ন করা হয়। এ সময় মাটির নিচে যে পাইপটি ছিল সেটির মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। সাধারণভাবে আবাসিক গ্যাস সংযোগে এমন পাইপ থাকার কথা নয়। আবাসিক সংযোগের ক্ষেত্রে পৌনে এক ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ পাওয়া যায়। তবে ওই ভবনের নিচে পাওয়া যায় দেড় ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ। পরবর্তী সময়ে তদন্ত করতে জানা যায়, ওই ভবনটি হওয়ার আগে সেখানে ছিল একটি টিনশেড বিল্ডিং, সেখানে ক্যাফে কুইন নামে একটি রেস্তোরাঁ ছিল। সেখানে বাড়ির মালিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিতাস গ্যাসের একটি এবং একটি বাণিজ্যিক লাইন ছিল। যখন বিল্ডিং তৈরি করা হয় তখনো ওই রেস্তোরাঁ এবং বাণিজ্যিক গ্যাসের লাইনটি ছিল। এরপর একসময় ওই রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়ে সেখানে স্যানিটারির দোকান ভাড়া দেওয়া হয়। এ সময় বাড়ির মালিক ওই বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগ বাদ দিয়ে আবাসিক গ্যাস সংযোগের আবেদন করে তিতাসে। তখন বাণিজ্যিক সংযোগের বদলে আবাসিক সংযোগ দিলেও ওই মোটা পাইপটি থেকে যায়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, তখন তিতাসের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলে যে, এই কাজগুলো করে তাদের তপশিলভুক্ত কিছু ঠিকাদার। তখন যেসব ঠিকাদার এই বাণিজ্যিক সংযোগকে আবাসিক সংযোগে রূপান্তরিত করা হয়েছে সে সংক্রান্ত কাগজ চাওয়া হয় তিতাস কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু তিতাস জানায়, এ-সংক্রান্ত তাদের কাছে কোনো ফাইল নেই। তিতাসের কাছে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়। এরপর আদালত নির্দেশনা দিলেও তিতাস এ-সংক্রান্ত কোনো কাগজ সরবরাহ করেনি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের পরিদর্শক রাইসুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, মামলার তদন্তকাজ চলছে। এরই মধ্যে ওই ভবনের মালিক এবং বেজমেন্টের দোকান মালিকের দায় চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি সংস্থার কাজে কী পরিমাণ গাফিলতি ছিল সেটা বের করতে আসলে তিতাস কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা দরকার। তাহলে দ্রুতই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া যাবে।
ঝুঁকি নিয়েই দাঁড়িয়ে ভবনটি
সিদ্দিকবাজার ঘটনার বিস্ফোরণের পর এখন পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। ঘটনার পরপরই ভবনটি ব্যবহার উপযোগী করতে রাজউকের গঠিত তদন্ত কমিটি পাঁচ দফা সুপারিশ করে। ভবনটির ক্ষতিগ্রস্ত কলামগুলোকে প্রোপিং করে সমান্তরাল সাপোর্ট দিয়ে ভবনটি স্থিতিশীল করতে প্রথম সুপারিশ করা হয়। দ্বিতীয় সুপারিশে ৪৫ দিনের মধ্যে ভবনটির ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট এবং তিন নম্বর সুপারিশে ভবনটির কাঠামোর সক্ষমতা বাড়াতে রেট্রোফিটিং করার কথা বলা হয়। চার নম্বরে সেগুলো সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ভবনটিতে কেউ বসবাস করতে পারবে না এবং পঞ্চম সুপারিশে বলা হয়েছে, সার্বিক দিক মূল্যায়ন করে কারিগরি কমিটি সনদ দিলে সেখানে বসবাস করা যাবে।
ঘটনার ৬ মাসের মধ্যে ভবনটি সংস্কার করে বাসযোগ্যের উপযোগী করে তোলার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত সেটি হয়নি। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখনো আতঙ্ক নিয়েই এই এলাকায় ব্যবসা করছেন তারা। ভবনের পাশের দোকানের ব্যবসায়ী মো. সজীব বলেন, ভবনটি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানেই আছে। এই ভবনের নিচ দিয়েই সবাই চলাফেরা করে। ভবনের নিচেই বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ব্যবসা করে অনেকে। মাঝে মাঝে ইঞ্জিনিয়াররা এখানে আসে। কতদিনে এই ভবন ঠিক হবে, আমরা কেউ-ই জানি না।
এ বিষয়ে কমিটির সদস্য বুয়েটের পুরাকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী কালবেলাকে বলেন, ভবনটি মজবুতীকরণের কাজ চলছে। এরই মধ্যে রাজউক একটি কোম্পানি নিয়োগ করেছে, যারা ভবনটিকে মজবুত করে আগের থেকে ভালো অবস্থায় নিয়ে যাবে। রাজউক এরই মধ্যে তাদের ডিজাইন চেক করে অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। আশা করছি আগামী ৬ মাসের মধ্যে ভবনটি ব্যবহারের উপযুক্ত হয়ে যাবে।