একসময় দোয়াতের কালি আর তালপাতায় শিক্ষাজীবন শুরু হতো। যুগের সঙ্গে বিলুপ্তি ঘটেছে সে প্রথার। বর্তমানে আধুনিক আর নিত্যনতুন পড়ার উপকরণ শিশুদের হাতে হাতে। তাই তালপাতায় লেখাপড়ার সেই গল্পটা এ প্রজন্মের কাছে অনেকটা রূপকথার মতো।
নতুন করে প্রাচীনকালের সেই রীতি মনে করিয়ে দেবে টুঙ্গিপাড়ার বড় ডুমুরিয়ার সার্বজনীন দুর্গা মন্দির প্রাঙ্গণের তালপাতার পাঠশালা। অর্ধশতাব্দী ধরে চলা এ পাঠশালাটি এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এখান থেকেই শিক্ষাজীবন শুরু করছে স্থানীয় শিশুরা। তবে কালের সাক্ষী পাঠশালাটির নিজস্ব ভবন না থাকায় সুপেয় পানি, স্যানিটেশনসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। সেগুলো সমাধানে দাবি জানিয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অভিভাবকসহ এলাকার সাধারণ মানুষ।
সরেজমিন গোপালগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম বড় ডুমুরিয়ায় দেখা যায়, গ্রামের শিশুদের হাতেখড়ি হচ্ছে প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে। দোয়াত থেকে বাঁশের কঞ্চির কলমে কালি তুলে তালপাতায় লিখছে তারা। এভাবেই তাদের শিক্ষাজীবনের শুরু। পাঠশালাটিতে ৫০টিরও বেশি শিশুকে তালপাতায় লেখার চর্চা করতে দেখা যায়।
শিক্ষক শিউলি মজুমদার বলেন, তালপাতায় অক্ষর চর্চায় হাতের লেখা ভালো হয়। এই পাঠশালা থেকেই গ্রামের শিশুরা প্রথম অক্ষরজ্ঞান লাভ করে। তারা স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জন বর্ণ, বানান, যুক্তাক্ষর, শতকরা, নামতা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা পায় এখান থেকে। এখানে শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়।
শুক্লা পাল নামে এক অভিভাবক বলেন, পাঠশালার শিক্ষক বাচ্চাদের পরম মমতায় হাতে ধরে তালপাতায় লেখা শেখান। এ কারণে আশপাশের প্রায় ৫ গ্রামের অর্ধশত শিশু এখানে পড়াশোনা করতে আসে। ভালো পড়াশোনার কারণে সবাই আগ্রহ নিয়ে সন্তানকে এই পাঠশালায় ভর্তি করি।
আরেক অভিভাবক সাথী কীর্তনীয়া বলেন, প্রতি শিক্ষার্থীর জন্য মাসে মাত্র ১০০ টাকা দিতাম। কিন্তু বর্তমানে টুঙ্গিপাড়ার ইউএনও শিক্ষক শিউলি মজুমদারের মাসিক বেতন দেওয়ায় এখন আমাদের টাকা দেওয়া লাগে না। এর প্রভাবে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা রাখি। শিক্ষকের বেতনের স্থায়ী ব্যবস্থা করায় প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাই।
বিবেকানন্দ বাইন নামে এক অভিভাবক বলেন, পাঠশালাটি সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলে। দুর্গা মন্দির প্রাঙ্গণে হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কারণে ক্লাস নিতে সমস্যায় পড়তে হয়। কখনো পাঠদান বন্ধ রাখতে হয়। আলাদা ভবন না থাকায় শিশুদের বিশুদ্ধ খাবার পানি ও টয়লেট সুবিধা নেই। তালপাতার এ পাঠশালার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে এসব সমস্যা নিরসনে সরকারি সহায়তা চাচ্ছি।
স্থানীয় বাসিন্দা আনন্দ মণ্ডল ও মনিতাপ মণ্ডল বলেন, এই পাঠশালা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় ৫০ বছর আগে। কিন্তু এখনো কোনো নিজস্ব ভবন নেই। মন্দিরের সামনের স্থানে ক্লাস নেওয়া হয়। আলাদা একটা ঘর হলে ভালো হতো। স্থানীয়ভাবে পাঠশালাটি দেখাশোনার পাশাপাশি সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ঐতিহ্যবাহী এ পাঠশালাটির সমস্যা সমাধানে উপজেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
এ বিষয়ে টুঙ্গিপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মইনুল হক বলেন, ডুমুরিয়ায় ইউনিয়নের বড় ডুমুরিয়ায় একটি পাঠশালায় এখনো পুরোনো আমলের তালপাতার শিক্ষাব্যবস্থা ধরে রেখেছে। সেখানে গিয়ে দেখেছি শিক্ষার গুণগত পরিবেশ নেই। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা যাতে শিক্ষার মানসম্পন্ন পরিবেশ পায় সেজন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করেছি।
তিনি আরও বলেন, তাদের লেখার জন্য হোয়াইট বোর্ড এবং বসার জন্য মাদুর দেওয়া হয়েছে। পাঠশালার একমাত্র শিক্ষক শিউলি মজুমদারের নিয়মিত বেতনের ব্যবস্থা করেছি।