খুলনা জেলা পরিষদের আলোচিত প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহাবুবুর রহমান মাহবুব। আওয়ামী লীগ আমলে প্রতাপশালী দ্বিতীয় শ্রেণির এই কর্মকর্তাই ছিলেন পরিষদের অঘোষিত চেয়ারম্যান। হাসিনা-পরবর্তী আমলেও থামেনি অপকর্ম। দুই দফায় বদলি হয়েও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন সরকারি আদেশকে। অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। দুর্নীতির শীর্ষে থাকা জেলা পরিষদ ৫ আগস্ট জনতার ক্ষোভের আগুনে পুড়ে ছাই হলেও ধ্বংসস্তূপে বসে এবার বিএনপি-জামায়াত নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ার চেষ্টায় মরিয়া মাহাবুব।
জানা যায়, খুলনা জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শেখ হারুনুর রশিদ। তিনিসহ দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় মাহবুব হয়ে ওঠেন দুর্দান্ত প্রতাপশালী। পরিষদে গড়ে তোলেন অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হয়েও নিয়েছেন প্রথম শ্রেণির সুযোগ-সুবিধা। মাহবুবের দাপটে অফিসের কর্মচারীরা সবসময়ই থাকেন তটস্থ ও বদলি আতঙ্কে। গণঅভ্যুত্থানের পর ৩০ লাখ টাকা চাঁদা চাওয়ার অভিযোগে তার নামে মামলাও হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ বয়োবৃদ্ধ হওয়ায় থাকতেন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। এ সুযোগে প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান ছিলেন ছায়া চেয়ারম্যান। প্রতিটি প্রকল্প বা উন্নয়ন কাজসহ সর্বক্ষেত্রেই চলত মাহবুবের চরম নৈরাজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতা।
অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী মিলন আহমেদ বলেন, মাহবুবুর রহমান অফিসে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করতেন। শুধু খবর নেন তার দুবার বদলি কেন হলো। আমি এখন অবসর নিয়েছি। সে আমার যে কোনো কিছু করতে পারে। তার অপকর্ম ঠেকাতে ঢাল হিসেবে অবৈধভাবে বের করেন দৈনিক একটি পত্রিকা, যার সম্পাদক ছিলেন তিনি নিজেই। সরকারি চাকরি করে অবৈধভাবে জনগণের টাকায় পত্রিকা বানিয়ে সাংবাদিকদেরই উল্টো হুমকি দিতেন। কোনো সাংবাদিক তার অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে তাকে নানাভাবে হয়রানি করতেন মাহবুব।
দুদফা বদলি ঠেকিয়েছেন: মাহাবুবুর রহমানকে খুলনা থেকে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর বগুড়া জেলা পরিষদে বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি সেখানে যোগ না দিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে খুলনাতেই থেকে যান। এরপর অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালের ১১ অক্টোবর তাকে চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদে ফের বদলি করে। সেখানেও যোগ না দিয়ে খুলনা জেলা পরিষদেই বহাল তবিয়তে আছেন তিনি।
দুর্নীতি করতে হাতিয়ে নিতেন প্রকল্প: জেলা পরিষদ মালিকানাধীন খুলনা সদরে পরিত্যক্ত ডাক বাংলোর জমিতে ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু কর্নার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। দুই বছর পর সেখানে মার্কেট তৈরি করে প্রায় ৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন মাহবুব। ডাক বাংলোর ওই জমির জেরে ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা চাওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। মিরাজ নামের ওই ব্যবসায়ী বলেন, টাকা দিতে না পারায় মাহাবুব আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে পথে বসিয়েছেন।
জানা যায়, ডুমুরিয়ার চুকনগর ডাক বাংলোর জমি থেকে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে সেখানে মার্কেট নির্মাণ করেন মাহবুব। পরে সেই জমি ভুয়া ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দ দিয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া পাইকগাছার কপিলমুনির ডাক বাংলোর জমি, দাকোপের ডাক বাংলোর জমি ও রূপসায় ডাক বাংলোর জমি অন্তত ৩৫০ জনকে একসনা ইজারা দেওয়া হয়। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে প্রায় ৮ লাখ টাকা করে আদায় করেন মাহবুব। শুধু এসব জায়গা থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন, যা জেলা পরিষদের কোষাগারে জমা হয়নি। প্রতি অর্থবছরে সামাজিক প্রকল্পের আওতায় মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, মন্দির-গির্জা, কবরস্থান-শ্মশান সংস্কার ও উন্নয়ন এবং গভীর নলকূপ স্থাপনে বরাদ্দের অর্ধেক টাকা জেলা পরিষদে ঘুষ দিতে হতো। এ নিয়ম তৈরি হয় মাহবুব খুলনা জেলা পরিষদে যোগদানের পর।
চুকনগরের ব্যবসায়ী মাসুদ ইসলাম জানান, ডাক বাংলোর জায়গায় তার চাচা শেখ কেরামত ও শেখ নুরুজ্জামানের নামে দুটি দোকানঘর ছিল। তাই নতুন মার্কেটে দোকানঘর পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার ছিল। অথচ তারা দোকানঘর পাননি। দুটি ঘরের জন্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান ৩০ লাখ টাকা চান। এত টাকা জোগাড় করতে না পারায় আমাদের বঞ্চিত করা হয়। পরে ওই দোকান দুটি ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
গড়েছেন সম্পদের পাহাড়: মাহবুবুর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার করে অফিস ভবনের পেছনে প্রকৌশলীদের ৩ তলা বাসভবনে সম্পূর্ণ একা বাস করেন। এতে মাসিক ৫০ হাজার টাকা ভাড়া হিসাবে চার বছরে ২৪ লাখ টাকা রাজস্ববঞ্চিত হয়েছে পরিষদ।
মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই পরিষদ পরিচালিত দৈনিক খুলনা পত্রিকার ছাপাখানা ক্রয় ও আনুষঙ্গিক কাজে ৪৫ লাখ টাকা ব্যয় করেন। এ ছাড়া সামাজিক প্রকল্প বিক্রি, ঘুষ গ্রহণ, সংস্থার ডাক বাংলোর জায়গা ইজারার নামে মার্কেট নির্মাণ করে দোকান বিক্রি, খেয়াঘাট ইজারা, মেরামত প্রকল্প ও এক হাজার আসনের অডিটোরিয়াম প্রকল্পে লুটপাট করে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন। এসব টাকায় ঢাকার কাঁঠাল বাগানে ২২০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট কিনেছেন। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায় পাঁচটি প্লট ও আলিশান বাড়ি রয়েছে তার।
মাহাবুবুর রহমানের সাতক্ষীরার বাড়ির প্রতিবেশী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সত্যরঞ্জন মণ্ডল বলেন, সাতক্ষীরায় আলিশান বাড়ি ও এর আশপাশে নামে-বেনামে অনেক সম্পত্তি রয়েছে মাহবুবের। বৈধ আয় দিয়ে একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা কীভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি করেন, অবাক লাগে। এ ছাড়া খুলনার মোহাম্মদনগরে ১০ কাঠা জমির ওপর ভবন নির্মাণ করছেন মাহবুব। পুরো জায়গা সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।
গতি পায়নি দুদকের তদন্ত: মাহাবুবুরের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ৩০ জুন দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার পরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়। পরে সব নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুদক অফিসে জেলা পরিষদের অর্থে স্টোর রুমের ছাদ নির্মাণ, ভবনের সামনের রাস্তা ও সাইকেল গ্যারেজ নির্মাণ করে দেয় জেলা প্রশাসন।
কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি সংস্থা গণপূর্তের মালিকানায় থাকা দুদকের এই ভবন সংস্কারের একমাত্র এখতিয়ারও তাদের। এ ছাড়া জেলা পরিষদ সিটি করপোরেশন এলাকায় কোনো উন্নয়ন কাজ করতে পারবে না। অথচ দুদকের হাত থেকে বাঁচতে ভবনের কাজ করে দেওয়া হয় পরিষদের পক্ষে।
খুলনা জেলা দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ কালবেলাকে বলেন, আমরা গণপূর্তের ভবনে ভাড়া থাকি। এই ভবনের সংস্কারসহ সবকিছুর দায়িত্ব গণপূর্তের।
গণপূর্ত-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী কামরুল আহসান বলেন, মাত্র ৪ দিন হলো বদলি হয়ে আসছি। এসব বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানাতে পারব। কোনো অনিময় হয়ে থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে ২০২২ সালের ১১ আগস্ট মাহাবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে খুলনার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার একটি আবেদনপত্রের তদন্ত করেন। তদন্তে অর্থ আত্মসাতের সত্যতা মেলে, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে মাহাবুবুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে সব সময় ষড়যন্ত্র হয়েছে, যা সম্পদ রয়েছে তা দিয়ে চাকরি ছাড়ার পর কোনো রকম দিন পার করতে হবে। তিনতলার দ্বিতীয় তলায় থাকি। বাকিগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। কেউ আবেদন করে না।
তিনি বলেন, আমার সম্পদের হিসাব আয়কর অফিসে দেওয়া রয়েছে। যারা আমার কাছে সুবিধা নিতে এসে পায়নি তারাই মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। ফ্ল্যাট ও জমি কেনার বিষয়ে মাহবুব বলেন, মোহাম্মদনগরে জমি রয়েছে। সেখানে ভবিষ্যতে ভবন নির্মাণ করা হবে। ঢাকার কাঁঠাল বাগানের ফ্ল্যাটটি আমার নামে নয়। সাতক্ষীরায় কিছু সম্পদ রয়েছে, যেগুলো কিনেছি। আমাকে বদলি করা হয়েছে অনিয়মের মাধ্যমে। এ বিষয়ে আদালতে মামলা করেছি। সেই মামলায় স্থিতাবস্থা জারি রয়েছে।