মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০০ এএম
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতা বাড়ছে

বাড়ছে শর্তও
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতা বাড়ছে

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে চলমান চার দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির আওতা বাড়ছে। অর্থাৎ অর্থের পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি সময় বাড়ছে আরও ছয় মাস। একই সঙ্গে বাড়ছে শর্তের বেড়াজালও। তবে ঋণের পরিমাণ কত বাড়বে, সে বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের বৈঠকে বিষয়টি দুই-তিন দিনের মধ্যেই চূড়ান্ত হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

যদিও দেশের আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আরও তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে, যা নিয়ে এরই মধ্যে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর।

সূত্রমতে, চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে প্রথম তিনটি কিস্তির অর্থের ব্যবহার ও শর্ত পরিপালনের অগ্রগতির পাশাপাশি সংস্কারেই বেশি জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কয়েকটি বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটির প্রতিনিধিদল। আইএমএফ মিশনের প্রধান ক্রিস পাপাদাকিসের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি আগামী ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করবে।

আইএমএফের সঙ্গে পৌনে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তিতে থাকা বাংলাদেশ সবশেষ তৃতীয় কিস্তির অর্থ হাতে পায় গত জুন মাসে। চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের জন্য ১২টি শর্তের বেশিরভাগ পূরণের পথে থাকলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইএমএফের শর্ত পরিপালনে সংস্কারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর্থিক খাতে বিশেষ করে ব্যাংক খাতের সংস্কার অগ্রগতি তুলে ধরা হয়েছে প্রতিনিধিদলটির কাছে।

আইএমএফ প্রতিনিধিদলের এবারের সফরে মূল্যস্ফীতি, ভর্তুকি কমানো ও রাজস্ব আদায়ে সংস্কারসহ অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. হাবিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আইএমএফের এটি রুটিন ভিজিট। তারা আর্থিক বিভিন্ন বিষয় রিভিউ করছে। সেই রিভিউয়ের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা আমাদের সংস্কার কার্যক্রমগুলো তুলে ধরছি। তবে অতিরিক্ত তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রস্তাবের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কোনো আলোচনা এখন পর্যন্ত হয়নি। সেটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও উপস্থিত থাকবেন।

চতুর্থ কিস্তি ছাড়ে আইএমএফের শর্তগুলোর মধ্যে আছে নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ, বাজেট ঘাটতি, আন্তর্জাতিক লেনদেনর ভারসাম্য, রিজার্ভ মানি, কর রাজস্ব, অগ্রাধিকার সামাজিক ব্যয় এবং সরকারের মূলধন বিনিয়োগ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকার এসব শর্তের বেশিরভাগ পূরণ করলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জুন পর্যন্ত সরকারের কর আদায়ের কথা ছিল তিন লাখ ৯৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত সরকার তিন লাখ ৬৯ হাজার ২০৯ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে। অর্থাৎ আইএমএফের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫ হাজার ৩২১ কোটি টাকা কম।

ঋণের চতুর্থ কিস্তি পেতে সবশেষ দুটি শর্ত বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি ঋণখেলাপি শ্রেণিকরণ করার সময় কমিয়ে ৯০ দিন করা হয়েছে। এর আগে প্রতিদিন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ধার দেওয়ার টুল রেপো সপ্তাহে একদিন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রিজার্ভ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়া অন্যসব শর্ত পরিপালন করতে পারায় তৃতীয় কিস্তির ছাড়ের সময়ে বাংলাদেশকে ‘ফ্রন্ট লোড’-এর মাধ্যমে ঋণ কিস্তির অতিরিক্ত ছাড় করেছিল আইএমএফ। ঋণের চতুর্থ কিস্তি পেতে অন্যান্য শর্তের সঙ্গে আগামী ডিসেম্বর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে বাংলাদেশকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৭ নভেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতির গ্রস হিসাবে তা ছিল ১৮ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের নিট হিসাব প্রকাশ করে না। শুধু আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থাকে জানিয়ে দেয়। তবে এই শর্তটিও পরিপালন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

আইএমএফের ঋণ কর্মসূচিতে দুই ধরনের শর্ত রয়েছে। যথাক্রমে সাতটি পারফরম্যান্স মানদণ্ডের সঙ্গে যুক্ত এবং বাকিগুলো কাঠামোগত মানদণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কিত। কর্মকর্তারা জানান, জুনের মধ্যে ২৭টি কাঠামোগত সংস্কার শর্তের মধ্যে পাঁচটি পূরণ করার কথা ছিল বাংলাদেশের। আইএমএফের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ এই পাঁচটি শর্ত পূরণ করেছে কি না তা মূল্যায়ন করবে এবং চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পূরণ করা অন্য কাঠামোগত সংস্কার শর্তাবলি নিয়ে পর্যালোচনা করবে।

কাঠামোগত সংস্কারের অন্যতম শর্ত ছিল একটি হালনাগাদ মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রকাশ, যেখানে ২০২৫ অর্থবছর থেকে ২০২৭ অর্থবছর পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অর্থ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে তা প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারমুখী করা, ব্যাংক ঋণে সুদ হারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে দেওয়া, ব্যাংক ঋণের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্য প্রকাশ, রিজার্ভের নিট হিসাব আইএমএফ স্বীকৃত পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী প্রকাশ, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, পুঁজিবাজারের উন্নয়নের মতো বিষয়ও রয়েছে আইএমএফের শর্তে, যার বেশিরভাগই বাংলাদেশ পরিপালন করেছে।

প্রতিনিধিদলের সফর শেষে আইএমএফের বোর্ড সভায় নতুন ঋণ যুক্ত হওয়া এবং চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এর আগে সফররত কর্মকর্তারা তাদের প্রাথমিক মতামত জানিয়ে দেবে। তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে বাংলাদেশে আসা আইএমএফের গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রোইকোনমিকস বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও এবারের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে রয়েছেন।

দশ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি সরকারের শীর্ষ পর্যায়, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে বৈঠক করছেন।

এদিকে, গত আগস্টে গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছিলেন, বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়াতে আইএমএফ এর কাছে আরও তিন বিলিয়ন ডলার চাইবে সরকার। বিষয়টি নিয়ে তিনি এরই মধ্যে আইএমএফের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। সবশেষ গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ অধিবেশনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ঋণের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা তখন বলেছিলেন, এটি ‘নতুন বাংলাদেশ’। আইএমএফ বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা করবে।

প্রসঙ্গত, বিগত সরকারের দূরদর্শী নীতির অভাবে বিদেশি মুদ্রার চরম সংকট তৈরি হয় দেশে। ফলে সংকট কাটাতে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণ চায়। কয়েক দফা আলোচনা শেষে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক সংস্থাটি। এ পর্যন্ত ঋণের প্রায় ২৩১ কোটি ডলার বাংলাদেশ হাতে পেয়েছে। ঋণের শর্ত হিসেবে বেশ কিছু আর্থিক ও নীতি সংস্কারে মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভিসা নিয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কঠোর বার্তা

গোলের বদলে ডিম! পাখির কারণে মাঠছাড়া ফুটবলাররা

আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, নিহত বেড়ে ২৫০

নিজেদের অজান্তেই গাজায় বড় সফলতা পেল ইসরায়েল

সিইসির সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক দুপুরে

ইন্দোনেশিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মারমুখী অবস্থান, আন্দোলনে নতুন মোড়

প্রিন্স মামুনের সেলুন কেনা নিয়ে মুখ খুললেন অপু বিশ্বাস

দুপুরের মধ্যে ঢাকায় বজ্রবৃষ্টির পূর্বাভাস 

দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে আজ

আফগানিস্তানে কেন বারবার ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানছে

১০

সাদাপাথরে যে সৌন্দর্য ফিরবে না আর

১১

আগস্টের ৩০ দিনে রেমিট্যান্স আসেনি ৯ ব্যাংকে

১২

বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষ পাঁচে ঢাকা

১৩

মাথায় টাক পড়ছে? ৫ অসুখের লক্ষণ হতে পারে চুল পড়া

১৪

৪৭তম ট্রফি জেতা হলো না মেসির, ফাইনালে মায়ামির লজ্জার হার

১৫

১৩০ বছরের ‘জিয়া বাড়ি’ আজও অবহেলিত

১৬

ফের আলোচনায় ভারতের সুপার স্পাই অজিত দোভাল

১৭

বিবিসি নাকি ভাই ভাই চ্যানেল, নারী সংবাদিক ভাইরাল

১৮

সুস্থ থাকতে রাতে ভাত খাবেন, না রুটি? যা বলছেন পুষ্টিবিদ

১৯

তাহসানের সংগীতের রজতজয়ন্তী পালন হবে অস্ট্রেলিয়ায় 

২০
X