বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের হর্ন রাজধানীজুড়ে মারাত্মক শব্দদূষণ তৈরি করেছে। মানুষ অতিষ্ঠ হলেও কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না শব্দদূষণ। যানজটে আটকা পড়ে থাকলেও কিছু চালক ক্রমাগত হর্ন বাজাতে থাকেন। নগরজুড়ে মারাত্মক শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারপাশের দেড় কিলোমিটার এলাকাকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ‘সাইলেন্ট জোন’ বা ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ওই ঘোষণার পরও সেটা কার্যকর করা যায়নি। নীরব এলাকায়ও যানবাহনগুলো ক্রমাগত হর্ন বাজাতে দেখা যায়।
মারাত্মক এই শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন রোগী, শিশু, বয়স্ক ও ট্রাফিক সদস্যরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শব্দ মানমাত্রার চেয়ে বেশি হলে তা মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বড় ধরনের হুমকিতে পড়তে পারে। হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু এলাকায় নীরব এলাকা হিসেবে সাইন দেওয়া আছে। কিন্তু ওইসব এলাকায়ও যানবাহনের চালকরা হর্ন ব্যবহার করেই যাচ্ছেন।
এমন বাস্তবতায় যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বাজানো বন্ধে তাৎক্ষণিক (অন দ্য স্পট) মামলার ক্ষমতা চেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এ নিয়ে গত ১৯ ডিসেম্বর ডিএমপি কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে। ডিএমপির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশা করছেন, যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বাজানোর বিরুদ্ধে শিগগিরই তারা মামলার ক্ষমতা পাবেন।
জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মো. সাজ্জাত আলী কালবেলাকে বলেন, যত্রতত্র গাড়ির হর্ন ও বিনা কারণে গাড়ির সাইরেন বাজানোর ফলে মারাত্মক শব্দদূষণ তৈরি হয়। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। ট্রাফিক পুলিশসহ পুলিশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ বিষয়ে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন না। যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বা সাইরেন বাজানোর বিরুদ্ধে অন দ্য স্পট মামলা করারও এখতিয়ার পুলিশের নেই। কমিশনার বলেন, বিষয়টি আমি ব্যক্তিগতভাবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জানিয়েছি। তিনি লিখিতভাবে প্রস্তাব দিতে বলেছেন। তাই আমরা শব্দদূষণের জন্য দায়ী যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষমতাসহ একটি বিধি প্রণয়নের জন্য লিখিত প্রস্তাব দিয়েছি।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হাইকোর্ট একটি বেঞ্চ রাজধানীর গুলশান, বনানী, অফিসার্স ক্লাব ও বারিধারা এলাকাসহ সারা দেশেই হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেন। হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই আদেশ দেওয়া হয়। আদেশে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ বিধি ১৯৯৭’ ও ‘শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধি ২০০৬’ অনুসারে নির্ধারিত মাত্রার বেশি শব্দ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ এবং শব্দ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নজরদারি (সার্ভিল্যান্স) টিম গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ওই সময় পুলিশের মহারিদর্শক (আইজিপি), বিভাগীয় পুলিশ কমিশনার (হাইওয়ে), ট্রাফিক পুলিশের যুগ্ম কমিশনার ও বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে ওই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই নির্দেশনা কেউ মানছেন না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুসারে, আবাসিক এলাকায় দিনের বেলা (ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা) ৫৫ ডেসিবল (শব্দের তীব্রতা পরিমাপের একক) এবং রাতে (রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা) ৪৫ ডেসিবল এবং নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ও রাতে ৪০, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ রয়েছে। তবে শব্দের সহনশীল মাত্রা যেখানে ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল থাকার কথা, সেখানে নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্নের কারণে ঢাকা শহরে শব্দের গড় মানমাত্রা দাঁড়িয়েছে ৯৫ ডেসিবল। এর ফলে শিশু থেকে বয়স্ক, এমনকি সাধারণ মানুষ ও ট্রাফিকের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে জানানো হয়, শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে ঢাকা। চতুর্থ স্থানে রাজশাহী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, একজন সুস্থ মানুষের শব্দ গ্রহণের সহনশীল মাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল। তবে ঢাকায় এই মাত্রা ১২০ ডেসিবেলের বেশি ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল; কিন্তু ঢাকা নগরীর কোনো কোনো এলাকায় নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হয়। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে সর্বস্তরের মানুষের অনিদ্রা, মাথাব্যথা, বধিরতা, কানে শোঁ শোঁ শোনা, হৃদরোগ ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয় রোগী, নারী, শিশু ও বয়স্করা।
এ বিষয়ে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডা. ইমরান খান বলেন, ‘অতিমাত্রার শব্দ মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। উচ্চ শব্দের কারণে মানসিক ও শারীরিক সমস্যাও হতে পারে। পাশাপাশি শব্দদূষণের কারণে মানুষ বধিরতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া ক্ষুধামান্দ্য, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়া, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ, শোঁ শোঁ করাসহ হৃদরোগ জাতীয় সমস্যাও তৈরি হতে পারে। শব্দদূষণের কারণে শিশুদের কানের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। বিকট শব্দের কারণে শিশুরা অনেক বেশি ভয় পেয়ে মানসিক সমস্যায় পড়তে পারে।’
ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, আইনগতভাবে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর গাড়ি আছে, সেগুলোতে সাইরেন বাজানোর এখতিয়ার আছে। তারা ছাড়া অন্য অনেকেই অযথা হর্ন ব্যবহার করছে। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে যতগুলো গাড়ি দেখেছি, সবটিতেই হাইড্রোলিক হর্ন পাওয়া গেছে। সরকারি-বেসরকারি গাড়ির চালক, তরুণ মোটরসাইকেল চালক, বাস, মিনিবাস, লেগুনাচালকরা বেশি ব্যবহার করছেন। অটোরিকশা, লেগুনা টাইপের গাড়িগুলোও হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করছে, যেগুলো বারবারই হর্ন দিতে দিতে গাড়ি চালাতে দেখা যায়। এগুলো বন্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি চালকদের সচেতনাতা তৈরি করাও জরুরি বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।
যানবাহের হর্ন যত্রতত্র ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান কালবেলাকে বলেন, আমরা বর্তমানে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করলে মামলা বা জরিমানা করতে পারি। এটা আমাদের এখতিয়ারে আছে। কিন্তু প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, ট্রাক, পিকআপ, জিপসহ বিভিন্ন টাইপের গাড়ি, মোটরসাইকেল কারণে অকারণে হর্ন বাজায় এবং সাইরেন ব্যবহার করে। আমরা এসব বিষয়ে অন দ্য স্পট জরিমানা বা মামলা করতে পারি না। এ বিষয়ে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনে জরিমানা ও মামলার বিধান চেয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। চিঠিতে ডিএমপি এলাকায় যত্রতত্র গাড়ির হর্ন বাজানো ও অকারণে অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য গাড়ির সাইরেন ব্যবহারে তাৎক্ষণিক মামলার ক্ষমতা চাওয়া হয়েছে। দেখা যাক মন্ত্রণালয় কী সিদ্ধান্ত জানায়।