আসন্ন গ্রীষ্মে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মার্চ থেকে গ্রীষ্মকাল শুরু এবং একই সময়ে পবিত্র রমজান ও সেচ মৌসুমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। লোডশেডিংয়ের ফলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়তে পারে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ৫ মাস পার হলেও বিদ্যুৎ খাতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। বরং বিভিন্ন সমস্যার কারণে এ খাতে হযবরল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
সরকার কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে নির্ভরযোগ্য করে তুলতে চাইলেও কয়লা পরিবহন সংক্রান্ত জটিলতা ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে, বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বকেয়া থাকায় তাদের পক্ষে উৎপাদন বজায় রাখা কঠিন হচ্ছে।
তবে সরকার বলছে, গ্রীষ্মকালীন বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। কয়লার মজুত বৃদ্ধি, সৌরবিদ্যুতের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের পরিকল্পনা রয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ আশা করছে, এসব উদ্যোগের মাধ্যমে সংকট কিছুটা কমানো সম্ভব হবে। তবুও আর্থিক সংকট ও অন্যান্য জটিলতার কারণে চ্যালেঞ্জ পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বকেয়া ৯ হাজার কোটি টাকা: গত ৮ জানুয়ারি বিদ্যুৎ সচিবকে বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা) একটি চিঠি দিয়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বকেয়ার অর্ধেক ১০ কর্মদিবসের মধ্যে পরিশোধের দাবি জানিয়েছে। তারা উল্লেখ করেছে, এ টাকা পরিশোধ না হলে আসন্ন গ্রীষ্মে ও রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার পিডিবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি বলে বিপ্পা সূত্রে জানা গেছে।
বিপ্পার উদ্বেগ: বিপ্পার সভাপতি কে এম রেজাউল হাসনাত জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদকদের ছয় মাসের বকেয়া টাকার কারণে তারা এখন জ্বালানি আমদানিতে অক্ষম। ব্যাংক থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। তিনি বলেন, বেসরকারি খাত থেকে আগামী গ্রীষ্মে ২০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না।
পিডিবির অবস্থান: পিডিবির চেয়ারম্যান জানান, বেসরকারি উদ্যোক্তারা বকেয়া নিয়ে চিঠি দিয়েছেন। তবে ৯ হাজার কোটি টাকার বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বেসরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা সমস্যা হবে, তবে শিগগির সমাধান খুঁজে বের করা হবে।
চিঠির বিবরণ: বিপ্পার চিঠিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী পিডিবিকে ৪৫ দিনের মধ্যে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু অর্থ প্রদান পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে বিলম্বিত হচ্ছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বিলম্বের কারণে সেচ মৌসুম, রমজান এবং গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এতে কৃষি, শিল্প এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
বেসরকারি খাতের সমস্যা: বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকরা জানিয়েছেন, বকেয়া টাকার অর্ধেক পরিশোধ করা হলে তারা ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে পারবেন। তবে জ্বালানি আমদানিতে ৪০-৪৫ দিন সময় লাগবে। এ ছাড়া টাকার অবমূল্যায়ন এবং সুদ পরিশোধে বিলম্বের কারণে তারা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়েছেন।
আর্থিক সংকট এবং জ্বালানি আমদানি: বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক অবস্থার অবনতির কারণে ঋণদাতাদের আস্থা কমেছে। ব্যাংকগুলো ডলারের বিনিময় হারে অসামঞ্জস্যের জন্য ঋণপত্র ইস্যু করতে অনীহা দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় সরবরাহ ঘাটতির জন্য আরোপিত লিকুইটি ড্যামেজ (এলডি) পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কয়লা পরিবহন খরচ বাড়ছে: দেশের বন্দরগুলোর চ্যানেলের নাব্য রক্ষা করতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য কয়লা পরিবহনে রক্ষণাবেক্ষণ ফি আরোপ করেছে। এই ফি চ্যানেলের ড্রেজিংয়ের খরচ মেটানোর জন্য নির্ধারিত হয়েছে। তবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই কয়লা পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় নাব্য নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কখনোই পূরণ হয়নি।
উৎপাদন খরচ বাড়ার শঙ্কা: নাব্যর অভাবে বড় জাহাজগুলো মাঝসমুদ্রে নোঙর করে এবং লাইটারেজ জাহাজে কয়লা পরিবহন করতে হয়। এতে খরচ এমনিতেই বেশি পড়ে। এর ওপর নতুন ফি আরোপ করায় খরচ আরও বাড়বে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলবে। ফলে পিডিবিকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অতিরিক্ত ৩৬০ কোটি টাকা ফি পরিশোধ করতে হবে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে ৮৩৯ কোটি টাকা চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ ফি দাবি করা হয়েছে। মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে ৪০০ কোটি টাকা ফি দাবি করা হয়েছে। ফি পরিশোধ না করায় পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা কয়লা খালাস করতে দেয়নি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ।
পিডিবির প্রতিক্রিয়া: পিডিবির চেয়ারম্যান বলেন, চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণের ফি কার্যকর হলে বিদ্যুৎ ভর্তুকি বর্তমানের তুলনায় অনেক বেড়ে যাবে এবং পিডিবি আর্থিক চাপে পড়বে। বিষয়টি নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ফি কার্যকর হলে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি অনিবার্য হয়ে উঠবে।
গ্যাস সংকট প্রভাব ফেলবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে: বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩০টির বেশি ছোট-বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এর প্রধান কারণ গ্যাস সরবরাহের অভাব। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট হলেও সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র এক হাজারের কম।
চাহিদা ও সরবরাহের বৈষম্য বিপুল: শীতকালে বিদ্যুতে গ্যাসের চাহিদা কিছুটা কম থাকলেও ফেব্রুয়ারি থেকে চাহিদা বাড়বে। মার্চ-এপ্রিলের গরমকালে এই চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ ১,২০০ থেকে ১,৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের চেষ্টা করা হবে। তবে এটি নিশ্চিত নয়, কারণ দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ক্রমাগত কমছে। সংকট মেটাতে এলএনজি আমদানি করতে এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
পিডিবি জানিয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে কখনোই চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যায় না। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে বাধ্য তারা। একই কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং বিদ্যুৎ ঘাটতির আশঙ্কা তৈরি হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা: বর্তমানে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৫ হাজার ৩৩৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক ১১,৩৭২ মেগাওয়াট (৪৫%), ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৬,৪৯২ মেগাওয়াট (২৬%), তেলভিত্তিক ৮২৬ মেগাওয়াট (৩%), কয়লাভিত্তিক ৩,৩০৪ মেগাওয়াট (১৩%), অনগ্রিড সৌরবিদ্যুৎ ৪৫৯ মেগাওয়াট (২%), জলবিদ্যুৎ ২৩০ মেগাওয়াট (১%), বিদ্যুৎ আমদানি হয় ২,৬৫৬ মেগাওয়াট (১০%)।
গ্যাস সংকট বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কমার পাশাপাশি এলএনজি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। সংকট নিরসনে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।