পুঁজিবাজারের একটি বিতর্কিত নাম জাভেদ অপগ্যানহাফেন, যিনি দুর্বল কোম্পানিকে বিশেষ কায়দায় সবল দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে পুঁজিবাজারে দুর্বল কোম্পানি তালিকাভু্ক্তির মাধ্যমে ব্যবসার নামে নিয়েছেন বিপুল ব্যাংক ঋণ। যে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটিতে। এদিকে তার নেতৃত্বাধীন কোম্পানিগুলো একের পর এক সংকটের মুখে। এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলোর ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে একটির শেয়ারদর নেমেছে সাড়ে ৩ টাকায়, আরেকটির ৮ টাকায়। কোম্পানিগুলোর যখন এমন রুগণ দশা, সে সময় তিনি ২৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্রান্সের প্যারিসে করেছেন নিজের বিয়ের অনুষ্ঠান।
জাভেদ অপগ্যানহাফেন দুর্বল কোম্পানির সবল কারবারি হিসেবেই পুঁজিবাজারে পরিচিত। তিনি মূলত দুর্বল কোম্পানিকে অতিরঞ্জিত করে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসেন। সেসব কোম্পানি তালিকাভুক্তির কয়েক বছরের মধ্যেই রুগণ হয়ে ওঠে, যার উদাহরণ হচ্ছে জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস, এসএস স্টিল এবং ফু ওয়াং সিরামিকস। এই তিনটি কোম্পানির নেতৃত্বে রয়েছেন জাভেদ। এসব কোম্পানি তালিকাভুক্তির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণসহ শ্রমিকদের অর্থও তছরুপ করেছেন তিনি। আর এসব অর্থ ব্যবহার করেছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। বিগত সরকারের আমলে ক্ষমতা ব্যবহার করে নিয়েছেন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ। অর্থ পাচারসহ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। শাস্তি থেকে বাঁচতে জাভেদ এখন গা-ঢাকা দিয়েছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নেক্সট জেনারেশনের চেয়ারম্যান জাভেদের বাবা তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী, কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাজীব শেঠিসহ আরও কয়েকজন পরিচালক দেশ থেকে পালিয়েছেন। ফলে কোম্পানিটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। রাজীব শেঠি বাংলাদেশে বসবাসরত একজন ভারতীয় নাগরিক।
জানা গেছে, আইপিওকালীন জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনে এমডি হিসেবে ছিলেন জাভেদ অপগেনহ্যাপেন। তখন কোম্পানিটিতে তার ৯৩ লাখ ১০ হাজার (১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ) শেয়ার ছিল। এই শেয়ারের ওপর ২০১১ ও ১২ সালে ২০ শতাংশ করে ৪০ শতাংশ বোনাস শেয়ার নেন তিনি, যা ২০১৩ সালে রাইট শেয়ারের আবেদনের আগেই বিক্রি করে দেন। পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত বোনাস শেয়ারসহ সব বিক্রি করে দেন। এরপরে জাভেদ অপগ্যানহাফেন পুঁজিবাজারে আনেন এসএস স্টিল। দুর্বল এ কোম্পানিটিকে পুঁজিবাজারে আনতে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করেন। এক্ষেত্রে তিনি শেয়ার ও নগদ অর্থ লেনদেন করেন। এই কোম্পানিটিও এখন চলছে ধুঁকে ধুঁকে। কোম্পানিটির নামে আছে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ। এসব ঋণ তিনি ব্যবহার করেছেন ব্যক্তিগত কাজে।
তথ্য বলছে, এসএস স্টিলকে ভুয়া প্লেসমেন্টের মাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে পুঁজিবাজারে আনা হয়েছিল। ২০২০ সালে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে প্লেসমেন্ট ইস্যু করা ১ কোটি ৮০ লাখ শেয়ার আত্মসাতের চেষ্টার অভিযোগ উঠলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ওই শেয়ার ফ্রিজ করে দেয়। কোম্পানিটির আর্থিক হিসাব নিয়ে নিরীক্ষকের নিরীক্ষাতেও উঠে এসেছে বিভিন্ন অনিয়ম, যা তদন্ত শেষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে বিএসইসি।
কোম্পানিগুলোর ঋণ ২৭০০ কোটি টাকা: ব্যবসার নাম করে কোম্পানিগুলো দেখিয়ে জাভেদ কয়েক দফায় নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ। যে ঋণের পরিমাণ ২০২৪ অর্থবছর শেষে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায়। এরমধ্যে এসএস স্টিলের স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৮৫৩ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। জাভেদের আরেক কোম্পানি জেনারেশন নেক্সটের স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৫৫ কোটি টাকা। আর ফু-ওয়াং সিরামিকসের স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে ২৯৩ কোটি টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ২৪৩ কোটি টাকা। কোম্পানিগুলোর সার্বিক অবস্থার অবনতির ফলে এসব ঋণ ব্যাংকগুলোর পাওয়া নিয়েও তৈরি হয়েছে সংকট। জাভেদের কোম্পানিগুলোকে ঋণ দেওয়া ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, ন্যাশনাল ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, আইডিএলসি ফাইন্যান্স, হজ ফাইন্যান্স, ট্রাস্ট ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এবং এবি ব্যাংক।
এ বিষয়ে একটি ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালবেলাকে বলেন, আমরা তো নিয়ম অনুযায়ী ঋণ দিয়েছি। ঋণের সব শর্ত পূরণ করেই ঋণ দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তার কোম্পানিগুলো যে কয়েক বছরের মধ্যেই এমন দুর্বল হয়ে পড়বে তা জানা ছিল না। ঋণ নেওয়ার সময় অনেক কিছু দেখিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তার সবগুলো কোম্পানির অবস্থাই বেশ দুর্বল। ফলে সময়মতো ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে। এ ছাড়া কোম্পানির কর্ণধাররা দেশের বাইরে অবস্থান করায় এ ঋণ পুরোপুরি আদায় করতে পারব কি না তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।
২৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে বিলাসী বিয়ে: জাভেদ অপগ্যানহাফেন গত ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আনুমানিক ২৫ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ২৯২ কোটি টাকা, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি ইউরো ১১৭ টাকা ১৬ পয়সা দরে) খরচ করে বিয়ে করেছেন দুবাইতে বসবাসরত ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইনফ্লুয়েন্সার ও উদ্যোক্তা রোজেমিন মাধবজিকে। সে বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর কর্ণধাররা। যাদের অধিকাংশই বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে জেলে এবং পলাতক রয়েছেন। জাভেদের পিতা তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের তৎকালীন হাইকমিশনার মুনা তাসনিমের স্বামী। জাভেজ অপগ্যানহাফেন তৌহিদুল ইসলামের প্রথম স্ত্রীর সন্তান।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা: সার্বিক বিষয়ে এসএস স্টিলের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ নুরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, আমি কোম্পানির ব্যাংক ঋণের বিষয়ে বলতে পারব না। এর জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। আর মালিকপক্ষ দেশের বাইরে থাকায় কোম্পানির ব্যবসায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কোম্পানির ব্যবসা তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আমরা আশা করছি, শিগগির এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।
জাভেদের আরেক কোম্পানি ফু-ওয়াং সিরামিকসের কোম্পানি সচিব এ হালিম ঠাকুর কালবেলাকে বলেন, আমাদের ব্যবসায়িক সকল তথ্য আর্থিক প্রতিবেদনে দেওয়া আছে। আর কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডির অবস্থানের বিষয়ে আমি কিছু বলতে আগ্রহী না। আরও কিছু জানতে চাইলে ই-মেইল করতে পারেন। পরে তাকে ই-মেইলে বিস্তারিত তথ্য লিখে পাঠালে কোনো উত্তর দেননি।
এদিকে জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ শাহজাহানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি।
অনিয়মের বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, অর্থবছর শেষে নিরীক্ষকের মতামতসহ তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন কমিশনে আসে। এতে কোন অনিয়ম বা অসঙ্গতি পেলে, কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এসএস স্টিল ও জেনারেশন নেক্সটের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হবে না।