প্রায় পাঁচ বছর পার হলেও ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগের সুপারিশ করতে পারেনি সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। বিধির বিড়ম্বনায় দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল এই নিয়োগ। এরপর সব ঝামেলা শেষ করে পিএসসি যখন চূড়ান্ত সুপারিশ করতে যাবে, ঠিক তখনই একটি রিট মামলায় ফের ঝুলে যায় নন-ক্যাডারের ৪ হাজার ৪৭৮টি পদের নিয়োগ। আজ সোমবার উচ্চ আদালতে এ মামলার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এ শুনানিতে আদালতের আদেশে নিয়োগজট খুলবে—এমন আশা নন-ক্যাডার প্রার্থীদের।
পিএসসি ও নন-ক্যাডার প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। পরের বছরের ৩ মে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং ২০২০ সালের ৪ থেকে ৮ জানুয়ারি হয় লিখিত পরীক্ষা। এরপর করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে এই কার্যক্রম। পরে গত বছরের ৩০ মার্চ এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয়। নিয়মানুযায়ী, স্বল্প সময়ের মধ্যে নন-ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করার কথা; কিন্তু হঠাৎ করেই বিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ায় ঝুলে যায় নিয়োগ প্রক্রিয়া। গত জুনে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ (বিশেষ) বিধিমালা ২০২৩ চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। এরপর ১৯ জুন নন-ক্যাডারের নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি করে পিএসসি। ২০ জুন থেকে ৫ জুলাই চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে পছন্দক্রম নেয় কমিশন; কিন্তু নিয়োগ সুপারিশের ঠিক আগমুহূর্তে দেখা দেয় নতুন সংকট।
চাকরিপ্রার্থীরা জানান, পিএসসি কর্তৃক প্রকাশিত পছন্দক্রম বিজ্ঞপ্তিতে ৪ হাজার ৪৭৮টি পদের মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নবম গ্রেডের ১৫৬টি পদও ছিল। এলজিইডি এই ১৫৬টি পদ বাতিল চেয়ে হঠাৎ করেই চিঠি ইস্যু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিট করে বসে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২২ জন প্রার্থী। তারা নিজেদের পক্ষে আদেশ পান। এ সময় এলজিইডি আপিল করলে হাইকোর্ট নন-ক্যাডার নিয়োগে স্থগিতাদেশ দেয়। এ কারণে পিএসসি প্রস্তুত থাকলেও আইনি জটিলতায় সুপারিশ পিছিয়ে যায়।
এদিকে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে হতাশ চাকরিপ্রার্থীরা। নূর মোহাম্মদ নামে এক চাকরিপ্রত্যাশী জানান, সরকারি চাকরির আবেদনের সময়সীমার শেষ সময়ে তিনি ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। এখন তার বয়স ৩৫ বছর। তাই, দ্রুত নিয়োগ সুপারিশের জন্য তিনি সরকারের প্রতি আকুল আবেদন জানান। অন্যদিকে, রিমি ও তাহের দম্পতি জানান, তারা দুজনই ৪০তম বিসিএসে নন-ক্যাডার প্রার্থী। দুইজনেরই চাকরি নেই এবং তাদের চাকরির বয়সও অনেক আগেই শেষ। এ মুহূর্তে তারা সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন।
নন-ক্যাডারপ্রত্যাশী মাসুদ সজীব কালবেলাকে বলেন, সরকার সব সময় জনবল সংকটের কারণে দ্রুত নিয়োগের লক্ষ্যে বিসিএস থেকে নন-ক্যাডার নিয়োগ দেয়। এই নিয়োগ আটকে গেলে সরকারি দপ্তরগুলোতে জনবল সংকট আরও তীব্র হবে এবং জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই আমরা আদালতের কাছে প্রত্যাশা করব মানবিক ও জনস্বার্থে বিবদমান পদগুলোর সঙ্গে আমাদের যাদের কোনোরূপ সম্পর্ক নেই, তাদের যাতে নিয়োগ প্রদান করার নির্দেশনা দেয়।
পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন কালবেলাকে বলেন, চাকরিপ্রার্থীরা আমাদের ভুল বুঝছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসি বিধির বাইরে যেতে পারে না। ২০১৪ সালের বিধি সংশোধনের পরে আইনসঙ্গতভাবে সুপারিশের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর আমরা যখন সবকিছু চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এলাম, তখন ১৫৬টি পদ প্রত্যাহার চেয়ে এলজিইডি একটি নোট পাঠায়। তখন কিছু প্রার্থী আদালতে রিট করেন। এর বিপরীতে এলজিইডি আপিল করলে আদালত নন-ক্যাডার নিয়োগে স্থগিতাদেশ দেয়। এর ফলে নন-ক্যাডার নিয়োগের সমস্ত কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। তিনি বলেন, কাল (সোমবার) উচ্চ আদালতে এ মামলার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। আদালতের আদেশের বাইরে পিএসসি কিছু করতে পারবে না। আমাদের কাজ করার ক্ষেত্রে আইনানুগ কোনো বাধা যদি না থাকে, আদালত যদি সেটি ক্লিয়ার করে দেয়, আমরা প্রস্তুত রয়েছি প্রার্থীদের সুপারিশের জন্য।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের প্রচুর লোকবলের দরকার। নন-ক্যাডার নিয়োগ আটকে যাওয়ায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের নানাবিধ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনেরও লোকবলের দরকার; কিন্তু রিটের কারণে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ৪০৩টি গুরুত্বপূর্ণ পদ আটকা পড়ে গিয়েছে। এ ছাড়াও ভূমি এবং কারিগরি সেক্টরেও লোকবলের অভাব। ৪০তম বিসিএস থেকে ভূমির ১ হাজার ৩৪২টি ও কারিগরির প্রায় ১ হাজার ৩৮০টি পদের নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু রিটের কারণে সেই পদগুলোতেও নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিএসসি ৪০তম বিসিএসের কার্যক্রম শেষ না করেই ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে। ৪৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফলও প্রকাশিত হয়ে গেছে; কিন্তু ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার নিয়োগ এখনো সম্ভব হয়নি। ফলে ৮ হাজার নন-ক্যাডার প্রার্থীর দুশ্চিন্তা বেড়েছে। তাদের নিয়োগ দেরি হলে পরের বিসিএসে নিয়োগে আরও জটিলতা তৈরি হতে পারে।
২০২২ সালের ৩০ মার্চ ৪০তম বিসিএসের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল প্রকাশের পর আগের বিসিএসের মতো করেই ফল তৈরির কাজ চলছিল; কিন্তু হঠাৎ করেই পিএসসি জানায়, আগের প্রক্রিয়ায় ফল প্রকাশ বিধিসম্মত নয়। তাই নতুন বিধির প্রয়োজন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ নন-ক্যাডার প্রার্থীরা আগের নিয়মেই ফলাফল প্রদানের জন্য পিএসসি প্রাঙ্গণে টানা ১৭ দিন আন্দোলন করেন; কিন্তু তাদের দাবি মেনে নেয়নি পিএসসি। বিধি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার ৬ মাস পর ১৪ জুন নতুন নিয়োগবিধি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এতে আশার আলো দেখেছিল নন-ক্যাডার প্রার্থীরা; কিন্তু রিটের কারণে তাদের নিয়োগ ফের আটকে যায়।
নিয়োগ প্রার্থীদের দাবি, ১৫৬টি পদের সঙ্গে অন্য ৪ হাজার ৩৩০ পদের কোনো সংযোগ নেই। এই ১৫৬টি পদ সরাসরি কারিগরি পদ। আর নন-ক্যাডার সংশোধিত বিধি এবং ৪০তম বিসিএসের নন-ক্যাডার বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ ছিল, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চাইলে যে কোনো মন্ত্রণালয়/বিভাগের পদ ও পদসংখ্যা হ্রাস বা বৃদ্ধি করতে পারবে। তাই যারা রিট করেছে, তাদের বাদ দিয়ে বাকি পদগুলোর ফল দ্রুত প্রকাশ করা হোক।
মন্তব্য করুন