দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকা উচ্চ মূল্যস্ফীতি অবশেষে নিম্নমুখী ধারায় ফিরেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, আগের মাসগুলোর তুলনায় গত মাসে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে দেশের মূল্যস্ফীতি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমেছে দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ মানুষের জীবনধারণের ব্যয় কিছুটা কমেছে। তবে একই সময়ে মানুষের আয়ও কমে গেছে। অর্থাৎ মানুষের ব্যয় কমার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে আয়ও। ফলে মূল্যস্ফীতি কমলেও স্বস্তি ফিরছে না জনজীবনে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত মাসিক ভোক্তা মূল্য সূচকের (সিপিআই) তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিএস।
সিপিআই সূচক অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে গড় মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। একই সঙ্গে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।
ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ হওয়ার অর্থ হলো, গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে যদি বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও সেবা কিনে সংসারের খরচ চালাতে ১০০ টাকা খরচ হয়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একই পণ্য ও সেবা কিনে সংসার চালাতে খরচ লাগছে ১০৯ টাকা ৩২ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৩২ পয়সা।
এদিকে, ১০ মাস পর খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমেছে ১০ শতাংশের নিচে। বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছে, যা জানুয়ারিতে ছিল ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমেছে প্রায় দেড় শতাংশ। এর আগে গত বছরের মার্চ মাসের পর খাদ্যের মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে নামেনি। সীমিত আয়ের মানুষ এত দীর্ঘসময় ধরে ভোগান্তিতে পড়েননি। গত মার্চে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বিবিএসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শীতের শাকসবজির দাম বেশ কম। চালের বাজারেও বেশি পরিবর্তন নেই। এসব কারণে ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। মূলত খাদ্য পণ্যের দাম কমায় গড় মূল্যস্ফীতি কমেছে। তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি হার ছিল ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত জানুয়ারিতে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। তাদের মতে, যাদের প্রতি মাসে আয়ের পুরোটাই সংসার চালাতে খরচ হয়ে যায়; কিন্তু হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম বাড়লে এবং সে অনুযায়ী আয় না বাড়লে তাদের ধারদেনা করে সংসার চালাতে হবে কিংবা খাবার, কাপড়চোপড়, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে কাটছাঁট করতে হবে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে মানুষের কষ্ট বাড়ে। প্রকৃত আয় কমে যায়।
এদিকে, দীর্ঘসময় ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমায় মানুষের ব্যয় কমেছে। এতে মূল্যস্ফীতির কারণে ভোগান্তিতে থাকা মানুষের জীবনে স্বস্তি ফেরার কথা। কিন্তু একই সময়ে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় আপাতত জনজীবনে সেই স্বস্তি ফিরছে না। কারণ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের কষ্টের সময়ে হঠাৎ দেশে গড় মজুরি বৃদ্ধির হার কমেছে। এমনিতে গত কয়েক বছর ধরে মানুষের আয়ের থেকে ব্যয় অনেক বেশি।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের মানুষের গড় মজুরি প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে মজুর বা আয় কমেছে দশমিক ৪ শতাংশ। এর আগে মোটামুটি ঊর্ধ্বমুখী ধারা ছিল মজুরি প্রবৃদ্ধি। যদিও মূল্যস্ফীতির হার ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে ব্যবধান এখনো ১ শতাংশের বেশি।
তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে কৃষি ও সেবা খাতে মজুরি কমেছে। কৃষি খাতে মজুরি প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ, জানুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের ব্যবধানে কৃষিতে মজুরি কমেছে দশমিক ০৭ শতাংশ। সেবা খাতে ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। অর্থাৎ সেবা খাতেও মজুরি বা আয় কমেছে দশমিক ০৭ শতাংশ। তবে শিল্প খাতে আগের মাসের মতো ফেব্রুয়ারিতেও একই রকম রয়েছে।
বিভাগের হিসাবে বেশি মজুরি কমেছে বরিশালে। ফেব্রুয়ারিতে মজুরি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ। সিলেটে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ, খুলনায় ৮ দশমিক ০৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৯৯, রংপুরে ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ থেকে কমে ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ হয়েছে।
এ ছাড়া, চট্টগ্রাম বিভাগে মজুরি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে মজুরি বেড়েছে রাজশাহী ও ময়মনমনসিংহ বিভাগে। এই বিভাগে মাসের ব্যবধানে ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৩১ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৮ দশমিক ০৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ সময় মজুরি প্রবৃদ্ধির হার অপরিবর্তিত রয়েছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে জানুয়ারির মতো ফেব্রুয়ারিতেও প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। বিবিএস কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ৬৩ পেশায় দৈনিক ভিত্তিতে বেতন পাওয়া অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের বেতন নিয়ে মজুরি সূচক প্রকাশ করে।
অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতি কমার প্রবণতাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তবে মজুরি প্রবৃদ্ধি কমার প্রবণতা সীমিত আয়ের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে বলে মনে করেন তারা। তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী এই ধারা অব্যাহত রাখতে আরও কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি মজুরি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। না হলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনধারণ অসহনীয় হয়ে যাবে। তারা বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে শীতের মৌসুম হওয়ায় সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সুলভ মূল্যে পাওয়া গেছে। যদিও মূল্যস্ফীতির মূল চ্যালেঞ্জ আসবে এপ্রিল থেকে। বাংলাদেশে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার শঙ্কা থাকে। ফলে ফসলের ক্ষেত নষ্ট হলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে।
মন্তব্য করুন