খেলাপি ঋণ গণনায় আগামী জুন পর্যন্ত শিথিল রাখার বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) অবহিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো মতামত জানায়নি সংস্থাটি। যদিও খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কী কী কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। আর দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুদ ও বিনিময় হার পুরোপুরিভাবে বাজারভিত্তিক করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তায়ও আপত্তি জানিয়েছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে আইএমএফের প্রতিনিধিদল। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ঢাকায় অবস্থানরত আইএমএফের প্রতিনিধিদলের বৈঠকে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র বলছে, বর্তমানে কোনো ঋণের কিস্তি বকেয়ার মেয়াদ ১৮০ দিন হলেই ঋণটি খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হয়। মার্চ প্রান্তিক থেকে এটি গণনার ক্ষেত্রে ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিন কার্যকর করার কথা ছিল; কিন্তু দেশের উচ্চ খেলাপি বিবেচনায় খেলাপি ঋণ গণনা আগামী জুন পর্যন্ত আগের নিয়মেই করতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টি আইএমএফকে জানানো হয়েছে।
দেশের ব্যাংক খাতের সুদের হার বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেওয়া হলেও এখনো বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি নিয়ন্ত্রণ করে বলে মনে করছে আইএমএফ। যেহেতু দেশের আর্থিক অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে, সেহেতু সুদের হারকে পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে বলেছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে মুদ্রা বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করতেও বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছে তারা। দীর্ঘদিন থেকেই এমন পরামর্শ দিয়ে আসছিল সংস্থাটি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আইএমএফের সঙ্গে চলা বৈঠকে মূল্যস্ফীতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। এ সময় তারা আগামী জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে না। সরকারের সবগুলো অঙ্গ (অর্গান) একসঙ্গে কাজ করলেই এটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
এখন পর্যন্ত ঋণ পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া উত্তরে আইএমএফ সন্তুষ্ট কি না জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে, তারা সন্তুষ্ট। যদি কোনো প্রশ্নের জবাবে তারা সন্তুষ্ট না হন, তারা তখন পাল্টা প্রশ্ন করেন।
তিনি আরও বলেন, ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ গণনার ক্ষেত্রে ডাবল কাউন্টিং হচ্ছে না। আইএমএফের নির্দেশনার আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে রিজার্ভ গণনা করায় তারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। মুখপাত্র বলেন, তারল্য সংকটে থাকা ১১টি ব্যাংকের মধ্যে ৬টি অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এখন আর তাদের তারল্য সহায়তা লাগবে না। তবে পাঁচটি ব্যাংক এখনো দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে, সরকারের পালাবদলের পর কিছু দুর্বল ব্যাংকে দেওয়া তারল্য সহায়তা নিয়ে গুরুতর আপত্তি জানিয়েছে আইএমএফ প্রতিনিধিদল। ব্যাংকে বাঁচিয়ে রাখার নামে গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে সেই টাকা ছাড়ের সুযোগ করে দেওয়ায় সংস্থাটি আগেই উদ্বেগ জানিয়েছিল। এবার এসব ব্যাংকের গ্রাহকের আস্থা ফেরানোর উন্নতি বিষয়ে নানা আঙ্গিকে প্রশ্ন করেন তারা। তারল্য সহায়তার জন্য দেওয়া ঋণের অর্থ ৯০ দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে এক প্রকার বাদানুবাদও হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তারল্য বিষয়ে নথি সরবরাহ করে বলা হয়, সেখানে ৯০ দিনে ধারের একটা টাকাও পরিশোধ করা হয়নি।
সূত্র জানায়, মিশনের সদস্যরা তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা। এ সময় আইএমএফ পরবর্তী করণীয় জানতে চায়। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, এই ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি কয়েকটি ব্যাংককে গ্যারান্টির বদলে সরাসরি টাকা ছাপিয়ে সহায়তা করা হয়েছে। তারপরও যদি উন্নতি না হয়, তবে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। সেই পদক্ষেপেও দৃশ্যমান উন্নতি না ঘটলে ব্রিজ করে ব্যাংকগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার নাম করে কলমানিতে বিনিয়োগ করেছে বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে। কেউ কেউ নিজেদের বেতন-ভাতার কাজেও তারল্য সহায়তার টাকা ব্যয় করেছে। এসব বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিব্রত। তবে এগুলো আইএমএফকে জানানো হয়নি। কারণ টাকা ছাপিয়ে সহায়তা করলে বাজারের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায় বলে তারা শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছিল।
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্ত পালনের অগ্রগতি পর্যালোচনায় আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি গত ৬ এপ্রিল থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করছে। আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত টানা দুই সপ্তাহ এই বৈঠক চলবে।
আইএমএফ প্রতিনিধিদল চলমান সফরে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি), জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বৈঠক শেষে ১৭ এপ্রিল প্রেস ব্রিফিং করবে সফররত আইএমএফ দল।
মন্তব্য করুন