মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে নৃশংসতা ও আওয়ামী লীগ আমলে গুম-খুনের বিচারসহ চার দফা দাবিতে আগামী ৩ মে শনিবার ঢাকায় মহাসমাবেশের আয়োজন করেছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক বৃহৎ সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সমাবেশে সংগঠনের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও বরেণ্য আলেমরা বক্তব্য দেবেন। পূর্বঘোষিত মহাসমাবেশ সফল করতে এরই মধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি শেষ করেছেন সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতারা। দেশের বিভিন্ন মহানগর, জেলা-উপজেলায় প্রচার-গণসংযোগ চালিয়েছেন নেতারা। দাবি সংবলিত লিফলেটও বিতরণ করা হয়েছে।
হেফাজতের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কালবেলাকে জানিয়েছেন, মহাসমাবেশ সফলে যা করার দরকার তারা সবই করছেন। সারা দেশে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী শনিবার অনুষ্ঠেয় মহাসমাবেশে সারা দেশের কয়েক লাখ মানুষের সমাগম ঘটবে। দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মহাসমাবেশ থেকে সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার কথাও চিন্তাভাবনা করছেন সংগঠনের দায়িত্বশীলরা। তা না হলে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে হেফাজতে ইসলাম।
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে নৃশংসতা ও আওয়ামী লীগ আমলে গুম-খুনের বিচারসহ চার দফা দাবিতে এ মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। গত ২৮ মার্চ বিকেলে ঢাকার জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় বিশেষ কমিটির জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন ইসলামী দলের সঙ্গে বৈঠক করা এবং আগামী জুনে সব জেলা ও মহানগর প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয় হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটির হিসাব মতে, সারা দেশে হেফাজত নেতাদের নামে প্রায় ৩০০টি মামলা রয়েছে।
গত ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামের খাস কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হেফাজত নেতৃবৃন্দ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও বেশকিছু জরুরি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১২ এপ্রিল বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে হেফাজতের শীর্ষ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল। সেদিন বিএনপির কাছে ৮ দফা প্রস্তাবনা তুলে দেয় হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম আগামীতে কারও ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হবে না। কোনো নির্বাচনী জোটে না যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে সংগঠনটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চারটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আগামী ৩ মে ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে হেফাজতে ইসলাম। দাবিগুলো হচ্ছে—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী প্রতিবেদন এবং কমিশন বাতিল, সংবিধানে বহুত্ববাদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল, ফ্যাসিবাদের আমলে দায়েরকৃত সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরসহ সব গণহত্যার বিচার, ফিলিস্তিনে এবং ভারতে মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে এই মহাসমাবেশ। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকাল ৯টায় মহাসমাবেশ শুরু হবে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা সাজিদুর রহমান গতকাল বুধবার কালবেলাকে বলেন, শনিবার অনুষ্ঠেয় মহাসমাবেশ ঘিরে তাদের যাবতীয় প্রস্তুতি প্রায় শেষ। এরই মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সফর করে গণসংযোগ করেছেন। মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। আশা করছি, মহাসমাবেশে লাখ লাখ লোকের সমাগম ঘটবে। বিভিন্ন জেলা থেকে লোক আসবে। দাবি আদায়ে মহাসমাবেশ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনো আলটিমেটাম দেওয়া হবে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা মহাসমাবেশের আগের দিন বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেব।
সাজিদুর রহমান আরও জানান, তারা সংগঠনের কেন্দ্রীয় বিশেষ কমিটির জরুরি সভায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাবনা গ্রহণ করেছেন। ধীরে ধীরে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাংগঠনিক কার্যক্রমও জোরদার করবেন। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম দেশ ও ইসলামের জন্য কাজ করছে এবং আগামীতেও করবে। ইসলামের মৌলিক বিধিবিধানের বিরুদ্ধে কোনো চাপিয়ে দেওয়া মতবাদকে কখনোই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।
হেফাজতের বিশেষ কমিটির ওই সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দল অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে দেশে ১৬টি বছর মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। দেশে গুম, খুন, সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনে প্রশাসনিক আদেশের মাধ্যমে এবং ১৯৭৮ সালের ‘দ্য পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স’ অনুযায়ী সরকার চাইলে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে পারবে। এই দাবি আদায়ে দেশের স্বার্থেই সব মত-পথ ও ঘরানার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য ইসলাম, দেশ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ওলামায়ে কেরামের ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। সভায় আরেক প্রস্তাবে সমাজের গরিব, অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।
গত ১২ এপ্রিল রাতে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা। সেদিন রাত ৮টার দিকে শুরু হওয়া বৈঠকটি প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলে। বৈঠকটি হেফাজতের আগ্রহেই অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের সমর্থন চায় বিএনপি। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হেফাজত নেতাদের উদ্দেশে বলেন, হেফাজতে ইসলাম অনেক বড় সংগঠন। বড় একটি সমর্থকগোষ্ঠী আছে। নির্বাচনে অবশ্যই আপনাদের সমর্থন চাইব। সবার সমর্থন পেলে আমাদের কাজগুলো সহজ হবে। এ সময় হেফাজতের নেতারা ইতিবাচক সাড়া দিলেও তারা বলেছেন, হেফাজতে ইসলাম কারও ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হবে না।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে হেফাজতের কয়েকজন শীর্ষ নেতা কালবেলাকে বলেন, ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করতে বিএনপি মহাসচিব হেফাজতের সমর্থন চেয়েছেন। দ্রুত নির্বাচন আয়োজনে আমাদের ভূমিকা জারি রাখার কথা বলেছেন। তারা বলেন, বিএনপি বড় দল। তাদের কাছে ইসলামী সংগঠন হিসেবে আমাদের বেশকিছু দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেছি। তারা প্রায় সবটায় সায় দিয়েছেন। বৈঠকে আমরা সবাই কথা বলেছি। বিএনপি কেন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছে না, সে বিষয়েও বিএনপি মহাসচিবের কাছে আমরা প্রশ্ন রাখি। জবাবে মহাসচিব বলেন, প্রতিটি দলের কিছু নিজস্ব পলিসি আছে; সীমাবদ্ধতা রয়েছে। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরা অন্য কোনো দলের নিষিদ্ধ চাইতে পারি না। জনগণ যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরাও এতে একমত থাকব। বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যের সময় হেফাজতের এক নেতা শেখ হাসিনা কর্তৃক বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আপনারা অন্তত শেখ হাসিনার সুরে তার আগের কথাটা তাকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। আমরা কোনোভাবে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে চাই না।
শনিবারের মহাসমাবেশ নিয়ে হেফাজতের নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী গতকাল কালবেলাকে বলেন, ঢাকা, বগুড়া, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশালসহ দেশের প্রায় সব জেলায় প্রস্তুতি সভা, গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। সারা দেশে অনেক টিম গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করেছে। তিনি বলেন, মহাসমাবেশ থেকে আমরা সরকারকে দাবিগুলো অনতিবিলম্বে পূরণের আহ্বান জানাব, তা না হলে নতুনভাবে সংগঠনের ফোরামে আলোচনা করে কর্মসূচি আসবে।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাদের মহাসমাবেশ ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রাণচাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। আমরা কোনো সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য এবং দেশে ইসলামবিরোধী কোনো আইন মেনে নেব না। আশা করি স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের তৌহিদী জনতা মহাসমাবেশে শরিক হবেন এবং দেশে ইসলামবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবেন।
মন্তব্য করুন