জাফর ইকবাল
প্রকাশ : ২৮ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৮ মে ২০২৫, ০৯:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিদেশফেরত নির্যাতিত নারীরা দেশেও পান না আশ্রয়

গৃহকর্মীর আড়ালে কিশোরী পাচার
বিদেশফেরত নির্যাতিত নারীরা দেশেও পান না আশ্রয়

‘মা তো কামে গেছে—রাইতে আইব। বাবা তো আমাদের ছাইড়ে চইলে গেছে। আমরা তো এখন গ্রামের বাড়িত থাকি না।’—কথাগুলো বলছিল ৯ বছরের শাহিনা আক্তার (ছদ্মনাম)। তার মা সৌদি আরবে গিয়েছিলেন স্বপ্ন নিয়ে, ফিরেছেন দুঃস্বপ্নের পাশাপাশি এক করুণ বাস্তবতা ফেরি করে। কারণ সমাজের তীর্যক দৃষ্টিতে সেই নারী আজ পরিবারেই পরিত্যক্ত।

সাতক্ষীরার এই নারী এখন গার্মেন্টসে কাজ করে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

কালবেলার দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে—গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো নারী অভিবাসী অনেকেই ফিরছেন শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে। তাদের অধিকাংশেরই ঠাঁই হয় না নিজ পরিবারে। যে পরিবার-সমাজের জন্য দেশের মাটিতে ঠাঁই ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে, সেই সমাজই পরবর্তী সময়ে তাদের জন্য হয়ে ওঠে নির্মম।

ঝিনাইদহের তৃণা বিশ্বাস (ছদ্মনাম) একটু ভালোভাবে বাঁচতে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। গিয়েই বুঝলেন—ভালো থাকার পথ কেবলই প্রলোভনের ফাঁদ। নির্যাতনের মুখে একপর্যায়ে তিনি দূতাবাসে গিয়ে সহায়তা চান। তৃণা বিশ্বাসের দাবি, পরে অন্য বাসায় তিনি কাজ ঠিক করলে দূতাবাসের কর্মকর্তারা তার কাছে দাবি করেন ২০ হাজার রিয়াল। দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। তৃণার ভাষায়, ‘বাসায় খাবার দিত না। একটা পাউরুটি, অর্ধলিটার পানি দিত। পানি চাইলে বলত—বাথরুমের পানি খাও। মারধর করত, চার মাসেও বেতন দেয়নি।’

ফিরে এসে আশ্রয় পাননি নিজ বাড়িতেও। পারিপার্শ্বিক টিপ্পনী আর পরিবার-প্রতিবেশীদের অবহেলায় তাকে বেছে নিতে হয় ভিন্ন জায়গা। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ধারদেনা করে নিতে হয়েছে চিকিৎসা।

সিন্ডিকেটের ভয়াল থাবা থেকে পালিয়ে এসেও বাঁচতে পারেননি ফাতেমা (ছদ্মনাম)। ‘বাপ-ছেলের সিন্ডিকেটের কবলে পড়লেই গন্তব্য দাসজীবন’—কালবেলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে আসে তার বর্ণনা। যশোর সীমান্ত দিয়ে ভারতের নিষিদ্ধ পল্লিতে বিক্রি হতে গিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি।

তবে ফিরেই শুরু হয় নতুন আতঙ্ক। দালাল চক্র ফাতেমার নামে নানা অপবাদ ছড়ায়, হয়রানি করে তার পরিবারকে। গ্রামের মানুষদের কাছে ওই নারীকে নিষিদ্ধ পল্লির কর্মী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এরপর পরিবার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, বের করে দেওয়া হয় গ্রাম থেকে। গ্রাম ছেড়ে বাঁচার তাগিদে নারায়ণগঞ্জে বিয়ে করেন। স্বামী সাইফুল্লাহ তাকে ভালো থাকার আশ্বাস দিলেও, পরে জীবনে নামে নতুন অন্ধকার। ভুক্তভোগী ওই নারী ফাতেমা কালবেলাকে বলেন, ‘সাইফুল্লাহ (নারায়ণগঞ্জের দালাল) আমাকে ভালো রাখার স্বপ্ন দেখায়। আমরা ভালোবেসে একপর্যায়ে বিয়ে করি। বিয়ের পর আমাদের একসঙ্গে থাকার ভিডিও ধারণ করে আমার স্বামী দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। আমাকে দিয়ে অসামাজিক কাজ করায়। সে নিজে আমাকে বিভিন্ন হোটেল ও বাসায় দিয়ে আসত। আবার সকালে গিয়ে নিয়ে আসত। এভাবে চার বছরের বেশি সময় চলতে থাকে। আমি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যাও করতে চেয়েছি। আমার তখন মনে হয়েছিল, এ জীবন রেখে কী লাভ। কোনো নারীর জীবনে যেন এমন স্বামী না পড়ে। ওরা এমন অনেক নারীকে দিয়ে এ কাজ করায়। পরে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করে দেয়। আমাকে যশোর সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করতে নিয়েছিল। আমি ওখান থেকে পালিয়ে আসি। ওরা আমার বাড়িতে গিয়ে চেয়ারম্যানসহ স্থানীয়দের কাছে আমার নামে বদনাম ছড়ায়। আমার বাবা-মাকে, পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় করা হয়। এরপর আমি আর আমার গ্রামে যেতে পারিনি। পরে আমি বিয়ে করি। আমার একটি সন্তান আছে। স্বামী বিদেশে থাকে। স্বামী বিদেশে যাওয়ার পর সেই দালাল চক্র আবার আমার পিছু লেগেছে। আমার নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানাসহ কয়েকটি জেলায় পাঁচটি মিথ্যা মামলা দিয়েছে। আমি একটা মামলায় জামিন নিলে তারা আর একটি মামলা দেয়। আমার আগের জীবন সম্পর্কে আমার স্বামী জানে না। জানলে আমার সংসার হয়তো টিকবে না। এভাবে আর কতদিন লড়াই করতে পারব জানি না। আমার এই সংসারটা যদি না টেকে, আমার সন্তান যদি সম্মান নিয়ে বড় হতে না পারে, তাহলে এ জীবন রেখে কী হবে। তখন আমার আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।’

সীমা আক্তার (ছদ্মনাম) নামের আর এক নারী বোয়েসেলের মাধ্যমে জর্ডান গিয়ে একই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। জানতে চাইলে ওই নারীর মা কালবেলাকে বলেন, ‘আমার মেয়েটারে ঠিকমতো খাবার দিত না। বেতন দিত না। মারধর করত। ৩ লাখ টাকা দিয়ে পাঠাইছিলাম। পরে গ্রামের গ্রামে চান্দা উঠাইয়া আরও দেড় লাখ টাকা দিয়া ফেরত আনি। এরপর মেয়েডা আমার চার মাস বিছানায় পইরা ছিল। এর মধ্যে গ্রামের মানুষ, আত্মীয়স্বজনের খারাপ কথা তো আছেই। একটু সুস্থ হয়ে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।’

তথ্যমতে, কোনো নারীকে গৃহকর্মী ভিসায় নিতে নিয়োগকারী সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিকে ১ হাজার ৫০০ ডলার দেন খরচ বাবদ। এই টাকা নারী কর্মীর মেডিকেল, প্রশিক্ষণকালীন যাতায়াত ভাতা, ফিঙ্গার, বিমান টিকিট, পাসপোর্ট, বিএমইটি ছাড়পত্রসহ আনুষঙ্গিক কাজ বাবদ খরচ করার কথা। নারী কর্মীকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার কথা। তবে ঘটে উল্টো। বিদেশে যেতে প্রায় প্রত্যেক নারীকেই দালালদের দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এরপর বিদেশে গিয়েও তারা শারীরিক, মানসিক, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হন। এরপর নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরতে চাইলেও দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। পরিবারের সচ্ছলতা আর দেশের রেমিট্যান্সের চাকা সচল করতে বিদেশে যাওয়া এসব নারী পরবর্তী সময়ে দেশে এসেও শিকার হন নানান ধরনের হয়রানির। পরিবারের অবহেলা, প্রতিবেশীদের টিপ্পনী আর সমাজের চোখে ভয়ংকর অপরাধী হয়ে কাটে তাদের জীবন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিদেশে মারধরের কারণে অনেক নারী কর্মীর জরায়ু ফেটে যায়। ফলে এসব নারীরা সন্তান ধারণে অক্ষম হয়ে পড়েন। অনেকক্ষেত্রে নিয়োগকারী ব্যক্তি ইচ্ছা করেই এ ধরনের নির্যাতন করে। এর ফলে শারীরিক সম্পর্কে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঝুঁকি থাকে না।

জনশক্তি রপ্তানি খাত নিয়ে কাজ করে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)। জানতে চাইলে ওকাপের চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘যেসব নারী সেক্সুয়ালি অ্যাবিউসড হয়ে দেশে ফেরেন তাদের পরিবারে ফেরা কঠিন হয়ে পড়ে। এমন অসংখ্য ভুক্তভোগী নারী আসেন আমাদের কাছে। তিনি আরও বলেন, ‘কিছু নারী অন্তঃসত্ত্বা আবার কেউ কেউ বাচ্চা নিয়েও দেশে ফেরেন। তাদের পরিবারে ফেরা এক ধরনের অসম্ভব। সমাজ ও পরিবার তাদের ভালো চোখে দেখে না।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহ নাভিলা কাশফি কালবেলাকে বলেন, ‘এসব গর্হিত কাজের সঙ্গে যদি সরাসরি সরকারি প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকে, তাহলে মানুষ কার কাছে যাবে। যেসব নারী আমাদের দেশের রেমিট্যান্সের চাকা সচল করতে দেশ ছাড়েন দেশে ফেরার পর তাদের আমরা জীবন্ত কবর দিয়ে দিচ্ছি। এটি গুরুতর অ্যালার্মিং বিষয়। এ দিকে আমাদের রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত। যারা জড়িত তাদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এই জঘন্য অন্যায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে দেশের মানুষের স্বার্থে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হোক কিংবা মন্ত্রণালয় অথবা কোনো প্রভাবশালী—আমাদের মনে রাখতে হবে কেউই বিচারের ঊর্ধ্বে নয়। সেইসঙ্গে ভুক্তভোগীদের সমাজে পুনর্বাসনেও সরকারকে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। সংবিধানের মালিক জনগণ। সরকারকে জনগণের স্বার্থেই কাজ করতে হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঘরে ঢুকে নারীকে গলাকেটে পুকুরে ফেলল মরদেহ

সাগরে নিম্নচাপ / বৃষ্টি কতদিন থাকবে, জানালেন আবহাওয়াবিদ

চাকরি দিচ্ছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, আবেদন করবেন যেভাবে

ট্রাম্পের পাশে থাকা মাস্ক অবশেষে সরে দাঁড়ালেন

চিফ ইঞ্জিনিয়ারের পরিকল্পনায় মোংলা বন্দরে জাহাজে ডাকাতি

আজ থেকে দেশের সব সোনার দোকান বন্ধ

সকাল থেকে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি

কেউ নিরাপদ থাকবে না, ইসরায়েলকে ইয়েমেনি বিদ্রোহীরা

বিনা টেন্ডারে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়ার অভিযোগ

সাভারে ছাত্রদলের কমিটিতে বিবাহিত ও ছাত্রলীগ কর্মী

১০

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১১

নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার : প্রধান উপদেষ্টা

১২

সকালে খালি পেটে এক মুঠো কাঁচা ছোলা কী কী উপকার করে

১৩

কে এই মোহাম্মদ সিনওয়ার, যাকে হত্যার দাবি করছে ইসরায়েল

১৪

পুশইনে ব্যর্থ হয়ে ককটেল ফাটিয়ে ফিরে গেল বিএসএফ

১৫

কেমন কাটতে পারে আজকের দিন, জেনে নিন রাশিফলে

১৬

যেসব এলাকায় ১১ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না আজ

১৭

টিভিতে আজকের খেলা

১৮

দুপুরের মধ্যে ৬ জেলায় ঝড়ের আশঙ্কা

১৯

পুশইনে ব্যর্থ হয়ে সীমান্তের বাতি বন্ধ করে ফেরত নিয়েছে বিএসএফ

২০
X