স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচির আওতায় বেশকিছু অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) ছিল সরকারের। গত বছরের জুনে শেষ হয় চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) ওপি। প্রস্তাবিত পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) ওপি জুলাইয়ে অনুমোদন হয়নি। ফলে ১১ মাস ধরে বেতন বন্ধ অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ারে (এএমসি) কর্মরত চিকিৎসকদের। তবুও চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
আশ্বাসে দিন পার করলেও কবে মিলবে বেতন, সে বিষয়ে নেই স্বচ্ছ রোডম্যাপ। পরিবার নিয়ে বেতনহীন মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। এএমসি প্রকল্পে চিকিৎসকদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ফার্মাসিস্ট, পরিদর্শক (ইউনানী, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক), কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী, হিসাব সহকারী, কম্পাউন্ডার পদেও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। তারাও দীর্ঘদিন ধরে বেতনবঞ্চিত।
এদিকে, চিকিৎসকদের সাপোর্ট স্টাফ কম্পাউন্ডার (২০২২ সালের নিয়োগ ব্যতীত) ও হারবাল অ্যাসিস্ট্যান্টের পদগুলো রাজস্বে স্থানান্তরিত হলেও সেবার মূল চালিকাশক্তি চিকিৎসকদের পদগুলো (১৯৯৯ সালের নিয়োগ ব্যতীত) রাজস্বে স্থানান্তরিত হচ্ছে না। তৃতীয় ও চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের প্রায় এক বছর বেতন না হওয়ায়, প্রকল্পের মেয়াদ এখনো বর্ধিত না হওয়ায় এবং প্রকল্পের জনবল রাজস্বে স্থানান্তরিত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভবিষ্যতে সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, শিক্ষার্থী ও সেবাগ্রহীতারা। বৈষম্য দূর করে বকেয়া বেতন ও চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করে অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ারের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের।
জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর প্রোগ্রামের (এইচপিএনপি) অধীনে ১৯৯৯ সালে ৪৫ জন ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক স্নাতক ডিগ্রিধারী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের বিভিন্ন জেলা সদর হাসপাতালে নিয়োগ করা হয়। এর মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রচলিত অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি সুপ্রাচীন, দেশজ ও হোমিও চিকিৎসা তথা ইউনানী, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাকেও মূলধারায় যুক্ত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে এইচপিএনএসপি প্রকল্পের তৃতীয় সেক্টর কর্মসূচির অধীনে ২২৬ জন এবং ২০২১ সালে চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচির অধীনে ১১০ জন কর্মকর্তার নিয়োগ সম্পন্ন হয়। যেখানে ৩টি মেডিকেল কলেজের প্রভাষক, মেডিকেল অফিসার, রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রারসহ জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার পদ রয়েছে। অধিদপ্তরের চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর প্রোগ্রামের (এইচপিএনপি) আওতায় অপারেশনাল প্ল্যানের (এএমসি) অধীনে ২০১৭-২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের জন্য প্রকল্পে অষ্টম ও নবম গ্রেডে রেজিস্ট্রার, আরপি, প্রভাষক, মেডিকেল অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। এতে প্রকল্পের মেয়াদ দাঁড়ায় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এদিকে ওপির কর্মকর্তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জন্য সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার প্রকল্পের তথ্যমতে, দেশের সরকারি ইউনানী এবং আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলায় কর্মরত ৩৫১ জন চিকিৎসক রয়েছেন। তারা দেশের ২৮ শতাংশ মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার (ইউনানী) ডা. তোফাজ্জল হোসেন বলেন, বেতনহীন মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলাম, সেই ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করতে পারছি না। সবকিছু মিলিয়ে খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। একবার শুনলাম গত এপ্রিলের শেষে বেতন হতে পারে। এখন জুন মাস চলে। বেতন কবে হবে, নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না।
সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রভাষক ডা. মোজাহিদ মিয়া বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার শেষ প্রান্তে এসে ২০২১ সালে যোগদান করেছিলাম। গত প্রায় ১ বছর ধরে বেতন নেই। এখন অন্য চাকরিতে যাওয়ারও সুযোগ নেই। এএমসি চিকিৎসা ব্যবস্থার অস্তিত্বের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের রাজস্বে আত্তীকরণ করলে হয়তো তিনটি চিকিৎসা খাতকে এত সংশয়, সংকটে থাকতে হতো না।
সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রভাষক ডা. মো. নাজমুল হুদা বলেন, জীবন চালানো দায় হয়ে গেছে। আমাদের রাজস্ব খাতভুক্ত করবে—আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ আমাদের পূর্ববর্তী একই প্রকল্পের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হয়েছে।
সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অধ্যক্ষ-কাম-অধীক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. রাশিদুজ্জামান খান বলেন, এটি একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হলেও এখানকার অধিকাংশ শিক্ষক প্রকল্পের জনবল। দুই বিভাগ মিলে মাত্র ৫ জন শিক্ষক রাজস্বের। তারাও ১-২ বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন। বর্তমান সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত এই প্রকল্প চলবে এবং এটাই সর্বশেষ প্রকল্প। তাই ২০২৬ সালের পর কীভাবে চলবে এই প্রতিষ্ঠান? সংকট নিরসনে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করে এই সমস্যা সমাধান করা দরকার।
বেতন কবে নাগাদ হবে—জানেন না খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার প্রকল্পের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. আবু জাহের। তিনি বলেন, অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার প্রকল্পসহ আমাদের বিভিন্ন অপারেশন প্ল্যানের ২৫ হাজার কর্মী বেতন পাচ্ছেন না। কবে হবে, সেটা বলাও মুশকিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতায় মোট ৩৮টি অপারেশনাল প্ল্যান আছে। এর মধ্যে অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি) একটি, যা পাঁচ বছর মেয়াদি। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পঞ্চম সেক্টর কর্মসূচি হবে দুই বছরের জন্য। বর্তমান ডিপিপি অনুযায়ী এক্সিট প্ল্যান তৈরি করে অত্যাবশ্যকীয় জনবল রাজস্বে স্থানান্তর করার কথা বলা হয়েছে। যেহেতু এটা সবশেষ প্ল্যান। এরপর রাজস্ব খাতে যাবে। হয়তো এ অপারেশনাল প্ল্যান এত দিনে অনুমোদন হয়ে যেত, কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে দেরি হচ্ছে। বিভাগের লোকজনের পরিবর্তন হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যক্তিও পরিবর্তন হয়েছে। নতুনরা এসে নতুন করে বুঝছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. রিজওয়ানুর রহমান বলেন, আমাদের অপারেশনাল প্ল্যানের যেসব অত্যাবশ্যকীয় কাজ ছিল, তার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি অনুমোদন হওয়ার কথা। ডিপিপি অনুমোদন হলে তখন এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে।
মন্তব্য করুন