বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৩:০৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একক বক্তৃতায় ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি

সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, অবকাঠামো উন্নয়নের পর এক জায়গায় থামাতে হবে। শুধু অবকাঠামো তৈরি করে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারেনি। যদি মানবসম্পদের সঙ্গে অবকাঠামো না মেলে, তা হবে কঙ্কাল। কারণ, অবকাঠামোর রক্ত, মাংস হচ্ছে উন্নত মানবসম্পদ। অন্যদিকে মানবসম্পদের উন্নয়ন না হলে বাংলাদেশের নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের ফাঁদে আটকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বলা হচ্ছে, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা। সেটা ভালো। তবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করলেই হবে না, মানসম্পন্ন শিক্ষাও দরকার।

শনিবার দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘কনভারসেশন উইথ প্রফেসর ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ’ শীর্ষক একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

এ সময় এই জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, অর্থনীতি পরিচালনায় সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এ কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। রিজার্ভ সংকুচিত হয়েছে। এর কারণ, দীর্ঘ সময় ধরে দেশে ডলারের বাজারকে ধরে রাখা হয়েছিল। এটা বাজারের ওপর ছাড়া হয়নি। যখন ছাড়া হয়েছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এ ছাড়া যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছিল। ভালো করছি বলে বিনিময় হারগুলো আমরা সময়মতো সমন্বয় করিনি। একদিকে বিদেশিদের কাছে বার্তা ছিল আমাদের রিজার্ভ স্থিতিশীল, অন্যদিকে আমরা যত ইচ্ছা প্রকল্প নিচ্ছিলাম। বলা হচ্ছিল, যথেষ্ট রিজার্ভ তো আছে। কোনো অসুবিধা নেই। রিজার্ভ দিয়ে দেশের অর্থনীতির মানদণ্ড বিবেচিত হলেও এটা যে বিনিয়োগের কোনো তহবিল নয়, সেটা বিবেচনায় আনা হয়নি। যে দেশ যত বেশি রিজার্ভ সংরক্ষণে রাখে, সেই দেশ সম্পর্কে বিশ্বে তত বেশি ইতিবাচক বার্তা যায়। এতে ওই দেশে বিনিয়োগ করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহিত হয়। অথচ আমাদের ক্রমবর্ধমান রিজার্ভ সংরক্ষণে না রেখে উল্টো কী করে খরচ করা যায়, তার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। এর দরুন ভবিষ্যতে যে হঠাৎ করে কোনো চাপ আসতে পারে, সেটা চিন্তায় ছিল না। আজকের অর্থনীতির যে অনিশ্চয়তা, মূল্যস্ফীতির যে উত্তাপ, তা মূলত এসব কারণেই তৈরি হয়েছে।

দেড় ঘণ্টারও বেশি ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের এ আলোচনায় উঠে আসে অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, অর্থ পাচার, বৈদেশিক বাণিজ্য, ভূ-রাজনৈতিক অর্থনীতি ও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশসহ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির নানা দিক।

অনুষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দাবি করেন, ‘আমরা কখনো সমন্বিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চলিনি। আমাদের আত্মতুষ্টি এসে গিয়েছিল। সবকিছুই ভালো আছে—ধরে নিয়ে সম্ভাব্য বৈশ্বিক সংকটকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যখন গুরুত্ব দিতে শুরু করল, তখন করার কিছু ছিল না, ফলে পদক্ষেপ নিয়েও তা খুব একটা কাজে আসছে না। এখন আমদানি ব্যয় কিছুটা কমিয়ে আনা গেলেও বৈদেশিক লেনদেনের সমস্যার সমাধান হয়নি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতন ঠেকানো গেলেও এখনো নিম্নমুখী চাপ রয়ে গেছে। বলা চলে, আমদানি-রপ্তানি একটা নিম্ন পর্যায়ের ভারসাম্যে আমরা আপাতত পৌঁছেছি, এটা আমাদের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা বা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সহায়ক হবে না। সবমিলে অর্থনীতিতে একটা অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতার সংকট তৈরি হয়েছে। বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি, রেমিট্যান্স আকৃষ্টকরণ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপে সুফল আসছে না।

বর্তমান বাজেট ব্যবস্থাপনা ও মুদ্রানীতি উভয়ই মূল্যস্ফীতি আরও উসকিয়ে দিতে পারে উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এটা একবার বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে এক ধরনের দাম বাড়ানোর প্রত্যাশা তৈরি হয়। যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। সামনে নির্বাচনের মৌসুমে টাকা লেনদেন বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতির ওপর আরও চাপ আসতে পারে। এর ওপর খাদ্যঘাটতি দেখা দিলে পরিস্থিতি সামলানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এ পর্যায় প্রেসটিজিয়াস প্রকল্পের চেয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের স্বস্তির জন্য কাজ করা জরুরি। যাতে এ শ্রেণির জনগণের জীবনমান বজায় থাকে।

বিদেশি ঋণমান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা একের পর এক বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প করে যাচ্ছি। এগুলো ঋণের মাধ্যমে করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক আছে প্রয়োজনীয়। অনেক আবার এ সময় প্রয়োজন ছিল না। গত ৩ বছরে আমাদের বৈদেশিক ঋণ ৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার হারে ঋণ ফেরত দিতে হবে। আমরা যদি ভবিষ্যতে আরও ঋণ নিতে থাকি, তাহলে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। এজন্য লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করে বড় অবকাঠামো প্রকল্প নেওয়ার পরামর্শ তার।

অর্থ পাচার প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিষয়ক এ শিক্ষক ও অধ্যাপক বলেন, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বের হয়ে গেছে। কেউ তো এ অর্থ ব্যাগে করে নিয়ে যায়নি। ব্যাংকিং সিস্টেমেই পাচার হয়েছে; কিন্তু সবকিছু ডিজিটাল হলেও তা ধরা যায়নি। ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য সুদের হার এক জায়গায় ধরে রাখা হয়। অপ্রিয় সত্য কথা বলা অর্থনীতিবিদদের এ দেশের সরকার পছন্দ করে না। এ সংস্কৃতি এখনো তৈরি হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থ পাচার হচ্ছে। এর নতুন নতুন ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে। পুঁজি পাচার হচ্ছে বলেই বেগমপাড়া আছে। সিঙ্গাপুরের চেইন হোটেলে বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ করছে। ডামি কোম্পানি তৈরি করে অর্থ পাচার হচ্ছে। অনিশ্চয়তায়ও পাচার বাড়ে। বৈধ আয় হলেও দেশের ওপর আস্থা না থাকলে অর্থ পাচার হয়।

বৈদেশিক বাণিজ্য ও ভূ-রাজনীতির বিষয়ে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের যে উৎপাদন শক্তি, তাতে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিবেচনায় চীনের ব্লকে যোগ দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে ভারসাম্য নেই। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের আমদানিনির্ভরতা চীন ও ভারতের ওপর। আবার উৎপাদিত পণ্য বিক্রির বাজার প্রধানত ইউরোপ, আমেরিকা। ফলে বাংলাদেশকে সব দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে হবে। কোনো জোটে যাওয়ার সুযোগ নেই। চীন, ভারতের সঙ্গে আমদানির জন্য সম্পৃক্ত থাকতে হবে। আবার রপ্তানির জন্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। সেখানেও রাজনীতি রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি মানবাধিকার ইস্যুতে জিএসপি প্লাস সুবিধা না দেয়, সেটা আমাদের জন্য ভালো হবে না।’ যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সাল থেকে ১৩০টি স্বল্পোন্নত দেশকে জিএসপি সুবিধা দিয়েছে। বাংলাদেশও এর মধ্যে ছিল। কিন্তু শ্রম অধিকার, মানবাধিকার ইস্যুতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশকে এ সুবিধা থেকে বের করে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এ সুবিধা তৈরি পোশাকের জন্য দরকার না হলেও হস্তশিল্প, রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য দরকার।

ব্রিকস প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক জোট। কিন্তু এ জোট খুব সফল হবে বলে মনে হয় না। কারণ, ব্রাজিল, ভারতের মতো দেশ চীনের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক হবে না। এ বাণিজ্য চুক্তিগুলো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাই এ বিষয়ে জাতীয় নীতি থাকা প্রয়োজন।’

এলডিসি উত্তরণ প্রসঙ্গে ওয়াহিদউদ্দিন বলেন, ‘২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ করবে। ফলে তার পরে বিশ্ববাণিজ্যে অনেক সুবিধা থাকবে না। কিন্তু উত্তরণের বাংলাদেশের প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে। ভিয়েতনাম ২৫ থেকে ৩০টি দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা কী? বাংলাদেশ সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টে (সাফটা) আছে। কিন্তু সাফটা কাজ করেনি।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

জুলাই সনদে মিত্রদের ‘কাছাকাছি মতামত’ দেওয়ার পরামর্শ বিএনপির

সন্তানকে বাঁচিয়ে প্রাণ দিলেন বাবা

সৈকতে ফের ভেসে এলো মৃত ইরাবতী ডলফিন

ইঞ্জিন সংকটে ‘নাজুক’ রেল অপারেশন

স্পেনে রিয়ালের আর্জেন্টাইন তারকাকে নিয়ে অদ্ভুত বিতর্ক

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হলেন আবু তাহের

মানবিক ড্রাইভার গড়তে নারায়ণগঞ্জে ডিসির যুগান্তকারী উদ্যোগ

গৃহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় জাতীয় পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত

পিএসসি সদস্য হলেন অধ্যাপক শাহীন চৌধুরী

রিয়ালের হয়ে ইতিহাস গড়লেন আর্জেন্টিনার ‘মাস্তান’

১০

দাম্পত্য কলহ এড়ানোর সহজ ৫ উপায়

১১

‘গণতন্ত্রের জন্য আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হতে পারে’

১২

আর্থিক খাত নিয়ে খারাপ খবর দিলেন গভর্নর

১৩

পৌরসভার ফাইল নিয়ে দুই কর্মকর্তার হাতাহাতি

১৪

কর্মস্থলে ‘অনুপস্থিত’, এবার পুলিশের ২ এসপি বরখাস্ত

১৫

এশিয়া কাপ দল নিয়ে তোপের মুখে বিসিসিআই

১৬

নারী-শিশুসহ ছয় ভারতীয় নাগরিক আটক

১৭

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার : উপদেষ্টা আসিফ

১৮

পিয়াইন নদীতে অবাধে বালু লুট, হুমকিতে বসতবাড়ি 

১৯

সোনালী ও জনতা ব্যাংকের অফিসার পদের ফল প্রকাশ

২০
X