মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জালিয়াতি করেও ফের দরপত্রে মেডিকিট

সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল
জালিয়াতি করেও ফের দরপত্রে মেডিকিট

দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে রাজধানী ঢাকার সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে এমআরআই ও সিটিস্ক্যান যন্ত্র সরবরাহ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেডিকিট করপোরেশন। কান্ট্রি অব অরিজিন, ম্যানুফেকচারিং ও শিপমেন্ট এক থাকার শর্ত ছিল; কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান শর্ত ভঙ্গ করে। দরপত্রের শর্তমতে, জাপান, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া ও নরওয়ের যে কোনো দেশ থেকে শিপমেন্টের কথা। কিন্তু মেডিকিট করপোরেশন শিপমেন্ট করে সিঙ্গাপুর থেকে। আর এই কারসাজি আড়াল করতে মুছে দেওয়া হয় সিঙ্গাপুরের নাম। এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি সরবরাহের জিডি-১০ প্যাকেজে। চুক্তি ভঙ্গ ও জালিয়াতির প্রমাণ পেয়ে দেওয়া হয় কারণ দর্শানোর চিঠি। কিন্তু সন্তোষজনক জবাব দিতে ব্যর্থ হয় মেডিকিট। পরে সরবরাহকারী এ প্রতিষ্ঠানটির অভিজ্ঞতা সনদ বাতিল করা হয়। এ যেন গুরু পাপের লঘু শাস্তিতেই দায়সারা কর্তৃপক্ষ। দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ ও জালিয়াতি প্রমাণের পরও গঠন করা হয়নি কোনো তদন্ত কমিটি। কালো তালিকাভুক্ত করা হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। তবে এখানেই শেষ নয়, জালিয়াতির পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই নতুন করে আহ্বান করা আরও পাঁচটি দরপত্রে অংশ নেয় মেডিকিট।

এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন হাসপাতালটির একাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। তাদের ভাষ্যমতে, রোগ নির্ণয়ের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি সরবরাহে জালিয়াতি জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। ভালো চিকিৎসার পূর্ব শর্ত রোগটি নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা। অথচ সেই রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় জালিয়াতি হচ্ছে। ধরা পড়ার পরও নেওয়া হচ্ছে না ব্যবস্থা। এতে প্রতারিত হবেন রোগীরা। অথচ কমিশনের লোভে ফের মেডিকিট করপোরেশনকে দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

কালবেলার হাতে আসা নথি অনুযায়ী, হাসপাতালের জিডি-১০ প্যাকেজের আওতায় বেশকিছু যন্ত্রপাতি কিনতে ২০২৩ সালের ২৬ জুলাই দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চুক্তি অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে যন্ত্রপাতি সরবরাহের কথা। এর আগে এমআরআই ও সিটিস্ক্যানসহ বিভিন্ন ভারী যন্ত্রপাতি কিনতে ওই বছরের ৬ মার্চ দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে বাংলাদেশ সায়েন্স হাউস, ড্যাফোডিল মেডি ওয়ার্ল্ড, লাইফস্ট্রিম ইন্টারন্যাশনাল, মেডি গ্র্যাফিক ট্রেডিং লিমিটেড এবং মেডিকিট করপোরেশন অংশ নেয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ৩৭ কোটি ৯৮ লাখ ৪৭ হাজার ২৪২ টাকায় এমআরআই ও সিটিস্ক্যান যন্ত্র সরবরাহের কাজ পায় মেডিকিট করপোরেশন। অথচ এর আগে মেডিকিটের এমন ভারী মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট সরবরাহের অভিজ্ঞতা নেই। তবুও সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে অভিজ্ঞতাকে আমলে না নিয়ে কাজটি দেওয়া হয়। প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক (পিডি) ফরহাদ হোসেন বলেন, দরপত্র অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা কাজ পেয়েছে। এক্ষেত্রে তার কিছুই করার ছিল না।

আরেকটি দরপত্রে ওভারসিস মার্কেটিং করপোরেশন (ওএমসি), জেনেসিস ট্রেডিং করপোরেশন, এইচটিএমএস লিমিটেড এবং এমএস হারামাইন এন্টারপ্রাইজ অংশ নেয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে ৬ কোটি ২৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকায় কাজ পায় ওএমসি। প্রতিষ্ঠানটি সিটিস্ক্যান ছাড়াও অটো বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার, অটো ইউরিন অ্যানালাইজার, অটো ইমিউনোসাই অ্যানালাইজার, অটো হেমাটোলজি অ্যানালাইজার ও অ্যাপারেসিস যন্ত্র সরবরাহ করতে বলা হয়। অথচ ওএমসির বিরুদ্ধে রয়েছে করোনা মহামারির সময়ে করোনা শনাক্তকরণ কিট সরবরাহের নামে সরকারের ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ। ওএমসি ৪০০ টাকার কিট সাড়ে ৩ হাজার টাকায় কিনতে বাধ্য করেছিল সরকারকে। এত অভিযোগের পরও কমিশনের লোভে প্রতিষ্ঠান দুটিকে কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়। সবছিল ঠিকঠাক! কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের মতো সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল সম্প্রসারণ প্রকল্পেও পরিচালক বদল করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. সিদ্দিকুর রহমানকে করা হয় নতুন পিডি। এরপর আওয়ামী লীগ আমলের কেনাকাটার নথি যাচাই করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে জিডি-১০ প্যাকেজের কেনাকাটায় মেডিকিট করপোরেশনের জালিয়াতি।

এতে দেখা যায়, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্যাকেজ জিডি-১০-এ রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের যন্ত্রপাতি কিনতে মেডিকিট করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি সই হয়। দরপত্র ও চুক্তির শর্তমতে যন্ত্রের কান্ট্রি অব ম্যানুফ্যাকচারিং, কান্ট্রি অব অরজিন এবং কান্ট্রি অব শিপমেন্ট একই হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু জিই হেলথকেয়ার ব্র্যান্ডের এমআরআই ১.৫ টেসলা মেশিন, সিটিস্ক্যান, বোন মিনারেল ডেনসিটোমেটারি (বিএমডি), রেডিওলজি কালার ডপলার ইউএসজি উইথ ইলাস্ট্রোগ্রাফি, রেডিওলজি কালার ডপলার ইউএসজি আইটেমগুলোর শর্ত ভঙ্গ করে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া ও নরওয়ের পরিবর্তে সিঙ্গাপুর থেকে শিপমেন্ট করা হয়েছে। এমআরআই ১.৫ টেসলা মেশিন শিপমেন্টের আগে পিএসআই (প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন বা পণ্য চালানের আগে সেগুলোর গুণগত মান যাচাই) করানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে ও সিটিস্ক্যান পিএসআই করানো হয় জাপানে। ক্রয়-সংক্রান্ত রেকর্ড সংরক্ষণে বিল অব এন্ট্রির কপি জমা দিতে মেডিকিট করপোরেশনকে কয়েকটি চিঠি দেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এরপর গত বছরের ১৭ নভেম্বর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেডিকিট করপোরেশনের জমা দেওয়া বিল অব এন্ট্রি ঢাকা কাস্টম হাউসে যাচাই করা হয়। এতে বিল অব এন্ট্রির জালিয়াতি ধরা পরে। এ ছাড়া জমা দেওয়া বিল অব এন্ট্রিতে কনসাইন অথবা এক্সপোর্টারের স্থলে সিঙ্গাপুর শব্দটি মুছে দেওয়ার প্রমাণও মেলে। জালিয়াতি চিহ্নিত হওয়ার পর কারণ দর্শাতে বলা হয় মেডিকিট করপোরেশনকে। কিন্তু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। তাই শর্ত অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সরবরাহে জালিয়াতির দায়ে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর জিডি-১০ এর আওতায় ইজিপি সিস্টেমে ইস্যুকৃত মেডিকিট করপোরেশনের অভিজ্ঞতার সনদ বাতিল করা হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল সম্প্রসারণ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক মো. সিদ্দিকুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘মেডিকিট করপোরেশন দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ ও জালিয়াতি করেছে। প্রমাণ পাওয়ায় তাদের যন্ত্রপাতি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অভিজ্ঞতা সনদ বাতিল করে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলাম। এখন আমি আর প্রকল্পে নেই। ওই বিষয়ের আর অগ্রগতি সম্পর্কে জানা নেই।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জালিয়াতির পরও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় নতুন করে আহ্বান করা সব দরপত্রে অংশ নিয়েছে মেডিকিট করপোরেশন। চলতি বছরের ২৫ মার্চ হাসপাতাল সম্প্রসারণ প্রকল্পের আহ্বান করা জিডি-১২এ, জিডি-১২বি, জিডি-১১বি, জিডি-১১সি এবং জিডি-১১ই প্যাকেজের প্রতিটিতে মেডিকিট করপোরেশন অংশ নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নতুন এই পাঁচ প্যাকেজের কাজও মেডিকিট করপোরেশনকে পাইয়ে দিতে হাসপাতালের একটি সিন্ডিকেট তৎপরতা শুরু করেছে।

জালিয়াতির বিষয়ে মন্তব্য জানতে মেডিকিট করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী শামীম আশরাফীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক মো. রফিকুল হক বলেন, ‘প্রকল্পে আমি দায়িত্বগ্রহণের আগে সাবেক পিডি মেডিকিট করপোরেশনের অভিজ্ঞতা সনদ বাতিল করেন। এরপর জালিয়াতির বিষয়ে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চোখ খুললেও কথা বলতে পারছে না মবের শিকার সেই ২ কিশোর

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ 

অনলাইনে যেভাবে কাটবেন বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস সিরিজের টিকিট

পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট?

প্লট দুর্নীতি / শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্য শুরু

ভাসমান বীজতলা তৈরিতে সফল খুলনার রোকেয়া

ব্রাজিল থেকে ১২০ টাকায় গরুর মাংস আমদানির খবর ভিত্তিহীন

ন্যূনতম কর একটা কালাকানুন : এনবিআর চেয়ারম্যান

ঈদে মিলাদুন্নবীর ছুটি যেদিন

শপথ নিলেন হাইকোর্টের ২৫ বিচারপতি

১০

সাকিবের প্রিয় ‘শিকারের’ তালিকায় তামিম, দেখে নিন পুরো তালিকা

১১

‘ভয়ংকর আফ্রিদির’ মুখোশ খুললেন তানভীর রাহী

১২

ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন শুরু

১৩

তথ্য গোপন করে প্রধান শিক্ষক, অতঃপর...

১৪

পুঁজিবাজারের প্রতারক চক্র গোয়েন্দা সংস্থার নজরে: ডিএসই

১৫

পরিবর্তন হচ্ছে বাংলাদেশ জেলের নাম 

১৬

চট্টগ্রামে সেপটিক ট্যাঙ্কে নেমে ২ শ্রমিকের মৃত্যু

১৭

রাতে খাওয়ার পরও ক্ষুধা লাগার কারণ জেনে নিন

১৮

বৃষ্টি-গরম নিয়ে নতুন বার্তা দিল আবহাওয়া অফিস

১৯

প্রেমের স্মৃতি টেনে কিমের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন ট্রাম্প

২০
X