গত অর্থবছরের শুরু থেকেই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন ছিল মন্থরগতি। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ নানা কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। সেখান থেকে কিছুটা গতি ফিরলেও সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়নের রেকর্ড এড়ানো সম্ভব হয়নি। বরং অযাচিত অর্থ খরচে সরকারের কঠোরতায় বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং পর্যাপ্ত অর্থছাড় না হওয়ার কারণে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার নেমেছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপির অগ্রগতি প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল বুধবার চলতি অর্থবছরের (জুলাই-জুন) এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আইএমইডি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বরাদ্দের হিসাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাদে বেশিরভাগই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি, ফলে ইতিহাসের সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপিতে ছিল ১ হাজার ৪৬৮টি প্রকল্প। সংশোধিত বাজেটে উন্নয়ন খাতে খরচের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে ৫৮ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা এসব প্রকল্পের বিপরীতে খরচ হয় মাত্র ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ৬৭.৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপির এক-তৃতীয়ংশ বাস্তবায়ন হয়নি।
গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে মাত্র ৫৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দের মোট ৬৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ খরচ করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। এটিও ইতিহাসে সর্বনিম্ন। অথচ করোনার সময়েও বিদেশি ঋণের প্রকল্পে খরচ করা হয়েছিল ৯২ শতাংশের বেশি।
আইএমইডির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগে কখনো এত কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। ওয়েবসাইটে ২০০৪-০৫ অর্থবছর পর্যন্ত এডিপির তথ্য দেওয়া আছে। সেখানে দেখা যায়, এর আগে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে। কারোনাকালীন ওই অর্থবছরে বাস্তবায়ন হার ছিল ৮০.৩৯ শতাংশ। করোনার সময় বেশিরভাগ উন্নয়নকাজ বন্ধ থাকলেও সেই বছর বাস্তবায়ন হওয়া প্রকল্পের হার গত অর্থবছরের চেয়েও সাড়ে ১২ শতাংশ বেশি। এমনকি এর আগে কোনো অর্থবছরেই ৮০ শতাংশের নিচে এডিপি বাস্তবায়ন হয়নি। বেশিরভাগ অর্থবছরেই ৯০ শতাংশের ওপরে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। সর্বোচ্চ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছিল ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই বছর বাস্তবায়ন হার ছিল ৯৪.৬৬ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাস্তবায়ন হার ছিল ৯৪.০২ শতাংশ, ২০১১-১২ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছিল ৯৩ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৯২.৭২ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯২.৭৪ শতাংশ এবং ২০০৪-০৫ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ছিল ৯২ শতাংশ।
এ ছাড়া ২০০৫-০৬, ২০০৯-১০, ২০১২-১৩ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছিল ৯১ শতাংশ, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ছিল ৮৩ শতাংশ, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৮২ শতাংশ, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৮৬ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৯.৭৬ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮২.১১ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৫.১৭ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়ন হার ছিল ৮০.৯২ শতাংশ।
এদিকে সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়ন হারের সঙ্গে মাসের হিসাবেও চলতি অর্থবছরেও শেষ মাসে কম খরচ হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুনে এডিপি বাস্তবায়নে খরচ হয় ৪২ হাজার ৪৪৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ সময় বাস্তবায়নের হার ১৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে খরচ হয় ৫৮ হাজার ৭৪২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের ২৩ দশমিক ০৯ শতাংশ। অর্থাৎ মাসের হিসাবেও গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বাস্তবায়ন হার কম।
আইএমইডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের অর্ধেকও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে স্বাস্থ্য খাত। সবচেয়ে কম বাস্তবায়ন হয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে। এ বিভাগটির এডিপি বাস্তবায়ন হার দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বাস্তবায়ন করেছে বরাদ্দের মাত্র ২১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এ ছাড়া, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের বাস্তবায়ন হার ৪২ দশমিক ০৫, জননিরাপত্তা বিভাগের ৩৯ দশমিক ৫৫, ভূমি মন্ত্রণালয় ৩৭ দশমিক ৪৬, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ৩২ দশমিক ০২ এবং বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের বাস্তবায়ন হার ৩৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
এডিপি বাস্তবায়নে সবচেয়ে এগিয়ে আছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা তাদের বরাদ্দের ৯৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। এ ছাড়া, বিদ্যুৎ বিভাগ বরাদ্দের ৯৮ দশমিক ১০ শতাংশ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৯৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ৯৮ শতাংশ, কৃষি মন্ত্রণালয় ৯১ দশমিক ০৭ শতাংশ, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ৯১ দশমিক ৫৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। এডিপি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এ বিভাগটির জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, অর্থবছর শেষে তারা খরচ করেছে ৩০ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের ৮৪ দশমিক ৫০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধাক্কা লাগে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে, যার ফলে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা দেয়। এতেই এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এডিপি বাস্তবায়ন না হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির পাশাপাশি অর্থের অপচয় হয় এবং সুফল পাওয়া যায় না। এডিপি বাস্তবায়ন হার বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। এজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নের দক্ষতা বাড়ানো এবং সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, অন্য অর্থবছরগুলোর তুলনায় এবার এডিপি বাস্তবায়ন কম হয়েছে, এটা ঠিক। তবে অন্য অর্থবছরগুলোর সঙ্গে এটার তুলনা করলে হবে না। গত অর্থবছর ছিল একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট। মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রভাবে এমনটি হয়েছে।
তিনি বলেন, গত অর্থবছরের পর অন্তর্বর্তী সরকার অযাচিত অর্থ খরচে কঠোর হয়। এ কারণে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়ার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। এসব কারণে কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে।
মন্তব্য করুন