সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে দানা বাঁধা আন্দোলন ঘিরে গত বছরের জুলাইয়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন দেশের বাইরেও এক শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা অর্থনৈতিকভাবে প্রতিবাদে অংশ নিয়ে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’য় পরিণত হন। বিদেশে থেকেও তারা শুধু কণ্ঠ নয়, অর্থনীতির শক্তি দিয়ে আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ান।
সে সময়ে ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করেন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় থাকা বাংলাদেশিরা। কর্মসূচির অংশ হিসেবে তারা বৈধপথে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখেন। এর মাধ্যমে সরকারকে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি তারা আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেন। প্রবাসীরা জানান, দেশের মানুষ যখন রাস্তায় জীবন বাজি রেখে প্রতিবাদ করছে, তখন তারা চাইছিলেন সক্রিয়ভাবে পাশে দাঁড়াতে। এ লক্ষ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বহু দেশে প্রবাসীরা নিজেদের সংগঠিত করেন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে রেমিট্যান্স শাটডাউনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। অনেকে আবার মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করেন। ফেসবুক, ইউটিউব ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে এ আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী।
দুবাই ও আবুধাবিতে আন্দোলনের প্রতি সমর্থনে প্রকাশ্য কর্মসূচি পালন করার কারণে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিকে সে সময় গ্রেপ্তার করা হয়। এ নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
তবে সরকারের পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে প্রবাসীদের মুক্তির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যস্থতায় আমিরাত সরকার বেশ কয়েকজন প্রবাসী আন্দোলনকারীকে মুক্তি দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, আন্দোলনের শুরুর দিকে দৈনিক রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। তবে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার পর আবারও প্রবাসীরা অর্থ পাঠানো শুরু করেন। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে মোট রেমিট্যান্স দাঁড়ায় ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রবাসীদের আস্থার একটি প্রকাশ।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের এ সাহসিকতা ও ত্যাগের স্বীকৃতি দিতে বিভিন্ন দেশে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা দিবস’ পালিত হয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসগুলোর উদ্যোগে আয়োজিত এসব অনুষ্ঠানে প্রবাসী নেতা, কূটনীতিক, সমাজকর্মী ও সাধারণ প্রবাসীরা অংশ নেন। এতে তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করা হয় এবং প্রবাসীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
সরকার এখন রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য আলাদা প্রণোদনা ও সম্মাননা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, যারা আন্দোলনের সময় নিজের জীবন, পেশা ও ভিসা নিয়ে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও দেশের স্বার্থে দাঁড়িয়েছেন, তাদের অবদানকে সম্মান জানাতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্যে একটি ‘রেমিট্যান্স বীর তহবিল’ গঠনের কথাও ভাবা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবাসীদের এ আন্দোলনের বিশেষ দিক হলো—এটি ছিল শান্তিপূর্ণ, সংগঠিত এবং সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক প্রতিরোধভিত্তিক। কোনো ধরনের সহিংসতা ছাড়াই প্রবাসীরা এমন এক অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলেন, যা সরকারের নীতিনির্ধারণী স্তরে চাপ সৃষ্টি করে। অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থা এ আন্দোলনের গুরুত্ব ও অভিনব কৌশল নিয়ে আলোচনা করে।
কুয়েতপ্রবাসী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা টাকা পাঠাই, এবার প্রতিবাদ পাঠিয়েছি। আমাদের পরিবার আছে, দায়বদ্ধতাও আছে, কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা সবচেয়ে বড়।’ এমন অনুভূতি প্রকাশ করেছেন আরও অনেক প্রবাসী, যারা মনে করেন, দেশের অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাদের জাতীয় দায়িত্ব ছিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই রেমিট্যান্স আন্দোলন ভবিষ্যতের গণআন্দোলনে এক নতুন দিকনির্দেশনা তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রবাসীদের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, ‘জুলাইয়ে আগের সরকারের ওপর অনাস্থা দিয়ে রেমিট্যান্স শাটডাউন ঘোষণা করেছিলেন প্রবাসীরা; কিন্তু সরকার পতনের পর তারা নতুন সরকারের ওপর আস্থা রেখেছেন। এজন্য এরই মধ্যে আমাদের রেমিট্যান্স এক বছরের সর্বোচ্চ ৩০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অর্জন করতে পেরেছি। আমরা আশা করব, এই ধারা অব্যাহত রাখবেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। এ ছাড়া আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ানোর আরও অনেক সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রবাসীদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। এজন্য সরকারকেও উদ্যোগ নিতে হবে।’
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক এর মধ্যে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ ও নিরাপদ করতে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে। পাশাপাশি ‘প্রবাসী স্বীকৃতি বন্ড’ চালুর পরিকল্পনাও সামনে এসেছে, যাতে রেমিট্যান্স প্রেরকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও বিনিয়োগ সুবিধা নিশ্চিত করা যায়।
আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘আজকের প্রেক্ষাপটে প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ভূমিকা শুধু তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবিলায় নয়, দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে থাকবে। জাতীয়ভাবে তাদের অবদান স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতের প্রজন্মকে প্রেরণা দেওয়া সম্ভব হবে।’
মন্তব্য করুন