সংস্কার ও দেখভালের অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বলিহার রাজকাছারি বাড়িটি। সাড়ে তিনশ বছর আগে কয়েক একর জায়গাজুড়ে কাছারি বাড়ির কার্যক্রম শুরু হলেও কালক্রমে আয়তন কমতে কমতে চুন-সুরকি ও ইটের গাথুনির দ্বিতল বিশিষ্ট স্থাপনাটি এখন দাঁড়িয়ে আছে এক একর জায়গার ওপর। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার পর পাকিস্তান এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার ভবনটি তহশিল অফিস হিসেবে ব্যবহার করলেও এটি সংরক্ষণে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।
জানা যায়, নওগাঁর বলিহার এলাকার জনৈক জমিদার মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে (১৬৫৮-১৭০৭) জায়গীর লাভ করেছিলেন। জায়গীর লাভের পর বলিহারের জমিদাররা নানা স্থাপনা গড়ে তোলেন। জমিদার নৃসিংহ চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠা করেন বলিহার রাজবাড়ি। সে সময়ই বগুড়ার শাজাহানপুরের আমরুল ইউনিয়নের ডেমাজানি বন্দরে গড়ে ওঠে রাজকাছারি বাড়ি। প্রতি বছর পালকিতে চড়ে রানি কুসুম কামিনী দেবীকে সঙ্গে নিয়ে জমিদার আসতেন ডেমাজানি কাছারি বাড়িতে।
কাছারি বাড়ির দোতলায় তিনটি কক্ষের একটি থাকত জমিদারের জন্য সংরক্ষিত। অন্য দুটি কক্ষে সপরিবারে থাকতেন নায়েব। এ ছাড়া নিচের তলায় থাকা তিনটি কক্ষের মধ্যে বড়টিতে চলত খাজনা আদায়ের কাজ। বাকি দুটি ব্যবহৃত হতো মালখানা হিসেবে। দক্ষিণ দুয়ারি ভবনের বারান্দার পশ্চিম পাশে একটি ছোট কক্ষে চলত পোস্ট অফিসের কাজ, যা এখনো চলমান আছে। আর পূর্বপাশের ছোট্ট কক্ষটি নানা কাজে ব্যবহার হতো, যা এখন গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজনন পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জনশ্রুতি আছে, জমিদারের উপস্থিতিতে বছরে একদিন ‘অন্নকুট’ পদ্ধতিতে খাজনা আদায় করা হতো। মাথায় পিতলের কলস নিয়ে জমিদারের কাছাকাছি বসতেন খাকি পোশাকের এক কর্মচারী। প্রজা সাধারণ একে একে কাছারি চত্বরে উপস্থিত হয়ে ওই পিতলের কলসে খাজনা জমা দিতেন।
জানা গেছে, ডেমাজানি রাজকাছারি বাড়ির অধিক্ষেত্র ছিল উত্তরে দুবলাগাড়ি, দক্ষিণে মির্জাপুর, পূর্বে বাঙালি নদী এবং পশ্চিমে বগুড়া-নাটোর সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত। দেশ বিভাগের সময়কালে বলিহারের রাজা ছিলেন বিমলেন্দু রায়। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময় জমিদার বিমলেন্দু রায় বাহাদুর সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমান। এরপর নওগাঁর বলিহার রাজবাড়ি দেখাশোনা করেন সেখানকার কর্মচারীরা। একইভাবে ডেমাজানি কাছারি বাড়িটিও দেখাশোনা করছিলেন কর্মচারীরা। বর্তমানে বাড়িটির প্রয়োজনীয় সংস্কার করে একে দর্শনীয় স্থানে পরিণত করা সম্ভব বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অরুণ কুমার সরকার বলেন, ‘এটা বলিহার রাজার স্মৃতিচিহ্ন। এখানে বসেই তারা খাজনা আদায় করতেন। এটা আমাদের ঐহিত্য। এটা আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ভবনটি এখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। যদি এটা সরকারিভাবে সংস্কার করা যায় তাহলে আরও ১০০ বছর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।’
আমরুল ইউনিয়ন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সেলিম রেজা বলেন, ‘ডেমাজানি রাজকাছারি বাড়ি শাজাহানপুরের ঐতিহ্য। এটা সংস্কার করলে শাজাহানপুরের ঐতিহ্য টিকে থাকবে। তবে সংস্কার করা হবে কি না, সে বিষয়ে আমার জানা নেই। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলব।’
শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাইফুর রহমান জানান, ‘ডেমাজানি রাজকাছারি বাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন ঐতিহ্য। এটাকে সংস্কার করা দরকার। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সংস্কার করার চেষ্টা করব।’
মন্তব্য করুন