কবির হোসেন
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০২:০৯ এএম
আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৪৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আদালতে কোর্ট ফির সংকট

বেশি দামে বিক্রি সিন্ডিকেশনের অভিযোগ
আদালতে কোর্ট ফির সংকট

সারা দেশে আদালতে কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের সংকট দেখা দিয়েছে। এসবের অভাবে মামলা দায়ের বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক জায়গায় কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের দাম বেড়ে গেছে। যদিও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ ঠিক রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছে দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন ও ডাক অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। তাহলে কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের সংকট কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সংকট তৈরি করা হচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন। এ অবস্থায় সরকারের রাজস্ব এবং মামলা ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে বাজারে কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের সরবরাহ নিশ্চিত এবং এ ব্যাপারে তদারকি বৃদ্ধি করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, নকল কোর্ট ফি ও জাল স্ট্যাম্প ব্যবহারের কারণে সরকার বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হয়ে আসছিল। একটি অসাধু চক্র জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। বিষয়টি ধরা পড়ার পর গত বছরের মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে নকল কোর্ট ফি ও জাল স্ট্যাম্প ব্যবহার বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এরপর গত বছরের জুলাই-আগস্ট থেকে অধস্তন আদালতেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। জাল কোর্ট ফি চিহ্নিতকরণে ‘ইলেকট্রনিক ডিভাইস’ (আইসিডি ইউভি এলইডি ফ্ল্যাশ লাইট) কেনা হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশের আদালতে এই ডিভাইস ব্যবহার করে কোর্ট ফি চেক করা হচ্ছে। এতে জাল কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প ব্যবহারের সুযোগ একেবারেই কমে গেছে। বেড়ে গেছে সরকারের রাজস্ব। প্রতি মাসে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকার রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদা বেড়েছে আসল কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের। জাল-জালিয়াতি বন্ধ হওয়ায় বাজারে কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের সংকট দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আইনজীবীরা বেশ কিছুদিন ধরে কোর্ট ফির সংকটের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের নজরে এনেছেন। রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. গোলাম রব্বানী বিষয়টি কার্যভার পালনরত প্রধান বিচারপতি মো. ওবায়দুল হাসানের নজরে আনেন। পরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশক্রমে গতকাল তিনি বিষয়টি নিয়ে অর্থ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রিন্টিং প্রেসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ সংকট সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।

জানা গেছে, দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্প ছাপিয়ে থাকে। ডাক বিভাগের চাহিদা অনুযায়ী তারা শুধু ছাপানোর ব্যবস্থা করে। ছাপানোর পর তা গুদামজাত না করে ৬৩টি জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকে ভেন্ডর ব্যবসায়ীরা ক্রয় করে থাকেন। পাশাপাশি সারা দেশের ডাকঘরগুলোতেও কিছুসংখ্যক স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি পাঠানো হয়। এগুলোর বেশিরভাগই রেভিনিউ স্ট্যাম্প। তবে আদালত প্রাঙ্গণে সাধারণত ভেন্ডর ব্যবসায়ীরাই কোর্ট ফি ও জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প সরবরাহ করে থাকে।

এক ভেন্ডর ব্যবসায়ী কালবেলাকে বলেন, বাজারে ৪, ৫ ও ১০ টাকার কোর্ট ফির সংকট বেশি। এগুলো তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে। ১০ টাকার কোর্ট ফি নেওয়া হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। বড় বড় কোর্ট ফির চালান ব্যাংকে জমা দিতে গেলে ফিরে আসতে হচ্ছে। যে কার্টিজ পেপার (স্ট্যাম্পের মতো ব্যবহার) আগে বিক্রি হতো ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা, সেটি এখন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিসি অফিসের ট্রেজারির মাধ্যমে ফলিও কেনা হতো প্রতি বান্ডিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। এখন প্রতি বান্ডিল ৩ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এসব বান্ডিল সরকারি রেট অনুযায়ী বিক্রি হওয়ার কথা ১ হাজার ১০০ টাকায়। তিনি আরও বলেন, কোর্ট ফি ও স্ট্যাম্পের জন্য প্রতি মাসের ১ থেকে ৭ তারিখের মধ্যে টাকা জমা দিতে হয়। এটি হাতে আসে ১৫ থেকে ২০ তারিখের দিকে। সর্বশেষ মাসে টাকা জমা দিয়েছি, কিন্তু সব ধরনের স্ট্যাম্প পাব না বলে আগেই ডিসি অফিস থেকে জানানো হয়।

অন্য এক ভেন্ডর ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, ডিসি অফিসের রেভিনিউ শাখায় আগে এক লাখ টাকার কোর্ট ফি কেনা হলে এক-দুই হাজার টাকা বাড়তি দিতে হতো। এতে সেগুলো তাড়াতাড়ি পাওয়া যেত। আর টাকা না দিলে একটু দেরি হতো। কিন্তু এখন বাড়তি টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে কোর্ট ফি নেই। অথচ অনেক বেশি টাকা দিলে পাওয়া যাচ্ছে। ওই ব্যবসায়ীর ধারণা, ডিসি অফিসের রাজস্ব বিভাগের কিছু কর্মকর্তা আর কিছু বড় ভেন্ডর মালিকের যোগসাজশে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এ কারণে বাজারে সংকট তৈরি হচ্ছে।

জানতে চাওয়া হলে দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ফোরকান হোসেন কালবেলাকে বলেন, ডাক অধিদপ্তর আমাদের প্রতিদিন যে পরিমাণ স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ছাপাতে বলে, আমরা প্রায় পুরোটাই ছাপানোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। প্রতিদিনই ট্রাক ট্রাক ছাপানো হচ্ছে। চাহিদার সামান্য বাকি থাকে। সংকটের কারণ জানতে তিনি ডাক অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

ডাক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (সরবরাহ ও পরিদর্শন) এস এম হারুন অর রশিদ কালবেলাকে বলেন, চাহিদা যে পরিমাণ পাচ্ছি, তা নিয়মিত দিয়ে দিচ্ছি। প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপানোর পর তা আর গুদামজাত হয় না। সংকটের পেছনে কোনো অপতৎপরতা চলছে কি না বুঝতে পারছি না। প্রতিটি জেলায় শত শত ভেন্ডার মালিক রয়েছে। ভেন্ডার মালিক রাডিসি অফিসের ট্রেজারি থেকে নেন। সেখানে কোনো মজুতদারি হলে তা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এর আগে নারায়ণগঞ্জ থেকেও সংকটের অভিযোগ এসেছিল, পরে তা সমাধান করা হয়।

এদিকে আইনজীবীরা জানিয়েছেন, কোর্ট ফি সংকটের কারণে মামলা দায়ের বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হাইকোর্টের বেশ কয়েকটি মামলা আদালতের অনুমতি নিয়ে কোর্ট ফি ছাড়াই দায়ের করা হয়েছে। অধস্তন আদালতেও সংকট দেখা দিয়েছে। ঢাকা জর্জ কোর্টের আইনজীবী আনোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ব্যাংকে কোর্ট ফি জমা দিতে গেলে এক মাস ঘুরতে হচ্ছে। ১০ টাকার কোর্ট ফি লাগছে ১৫ টাকা। বড় বড় কোর্ট ফির চালান জমা দিতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে, সেটাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মামলা দায়েরও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

কোর্ট ফি: বিচার বিভাগে মামলা দায়ের, আবেদনপত্রসহ আদালতের নানা কাজে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, ইমপ্রেস কোর্ট ফি, অ্যাডহিসিভ কোর্ট ফি এবং রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যবহার হয়ে থাকে। নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা মূল্যের, ইমপ্রেস কোর্ট ফি ২৫ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা মূল্যের, অ্যাডহিসিভ কোর্ট ফি ২ টাকা থেকে ২০ টাকা মূল্যের এবং রেভিনিউ স্ট্যাম্প ১০ টাকা মূল্যের হয়ে থাকে। এর বাইরে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে বড় অঙ্কের কোর্ট ফি দেওয়া হয়।

বর্তমানে উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের ক্ষেত্রে ২২০ টাকা, কখনো কখনো ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত কোর্ট ফি দিতে হয়। রিটে এনেক্সারের সংখ্যা বেশি হলে এনেক্সার প্রতি ২০ টাকা বেশি ফি দিতে হয়। দেওয়ানি মামলায় কোর্ট ফি সর্বোচ্চ ৪২ হাজার ৫০০ টাকা। কোম্পানি নিবন্ধনে কোর্ট ফি শোধ করতে হয় অনুমোদিত পুঁজির ওপর। কোম্পানি ভেদে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ৮০ থেকে ৯০ লাখ পর্যন্ত কোর্ট ফি দিতে হয়। মূলত মোকদ্দমার মূল্যমানের ওপর বা দাবির মূল্যমানের ওপর কোর্ট ফি নির্ধারিত হয়। এ ছাড়া ঘোষণামূলক মোকদ্দমায় প্রতি ঘোষণায় কোর্ট ফি ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা, রেভিনিউ অফিসের দরখাস্তের কোর্ট ফি ৪ টাকা থেকে ২০০ টাকা (বর্তমানে ২০ টাকা), আপিলের কোর্ট ফি ২০ টাকা থেকে ১০০ টাকা, ফৌজদারি আদালতের দরখাস্ত ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা, সিভিল আদালতের আর্জি ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা, মেমো অব আপিল ৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা, বেল বন্ড ১০ টাকা থেকে ২৫ টাকা, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং দাম্পত্য জীবন পুনরুদ্ধার ২০ টাকা থেকে ২০০ টাকা, ওকালতনামা ১০ টাকা থেকে ৩০ টাকা, সরকারি অফিসের রেভিনিউ ২০ টাকা থেকে ২০০ টাকা, দেওয়ানি রাজস্ব আদালতের আদেশ পরিবর্তন ১০০ থেকে ২০০ টাকা এবং পারিবারিক মামলা ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়। মানি স্যুট বা অর্থঋণ মোকদ্দমার ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন কোর্ট ফি ৩০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা। দেওয়ানি মোকদ্দমার সর্বনিম্ন কোর্ট ফি ৩০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা। সাকসেশন উত্তরাধিকার মোকদ্দমায় ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ফ্রি। পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ১ শতাংশ এবং পরবর্তী ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ২ শতাংশ হারে কোর্ট ফি দিতে হয়। মামলা দায়ের ছাড়াও মামলার রায়ের নকল কপি উঠাতে দিতে হয় কোর্ট ফি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকের সাক্ষাৎ

সাতক্ষীরা সীমান্তে বিজিবির বিশেষ অভিযানে ভারতীয় মালামাল জব্দ

ডাকসু নির্বাচন / বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্যানেল ঘোষণা

‘দেখামাত্র গুলির নির্দেশ’ বার্তা ফাঁসকারী পুলিশ সদস্য রিমান্ডে

যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বপ্নভঙ্গের হতাশা

ভিসা নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকেও পাল্টা জবাব দিল ইসরায়েল

ছাত্র রাজনীতি বন্ধের এক বছর, কী ভাবছেন ইডেন শিক্ষার্থীরা

কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের নতুন সচিব রফিকুল ইসলাম

৪০ দিন আগেই কি মানুষ নিজের মৃত্যুর কথা বুঝতে পারে?

বনানীতে সিসা বারে রাব্বী হত্যায় ৪ আসামি রিমান্ডে

১০

সীতাকুণ্ডে গণশুনানিতে সমস্যার কথা শুনলেন ডিসি ফরিদা খানম

১১

আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যমের দাবি / শেষবারের মতো আর্জেন্টিনা জার্সিতে নামছেন মেসি!

১২

জনগণ অসন্তুষ্ট হলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে : নজরুল ইসলাম

১৩

জানাজায় ব্যস্ত খামারি, সেই সুযোগে ৮০০ হাঁস লুট

১৪

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে থাকছে না দলীয় প্রতীক, অধ্যাদেশ জারি

১৫

‘বিএনপিকে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের নেতারা বিশ্বাস করে’

১৬

৩৬ হাজারে বিক্রি ২৪ কেজির কোরাল

১৭

কিছু বিষয় আলোচনা না হলেও জুলাই সনদে রাখা হয়েছে : সালাহউদ্দিন

১৮

খাবারে বিষক্রিয়া, বন্ধ হলো রণবীরের সিনেমার শুটিং

১৯

ভিটাসহ শ্বশুরবাড়ি বিক্রি করে দিলেন নাজমুল

২০
X