শৈশব থেকেই বার্জিস শাবনাম বর্ষার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল মাহীর রহমানের। তবে টানা ৯ বছরের এ সম্পর্কে আর থাকতে চাচ্ছিলেন না বর্ষা। যা নিয়ে এক বছর ধরে দুজনের মধ্যে চলছিল টানাপোড়েন। এরই মধ্যে গৃহশিক্ষক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা মো. জোবায়েদ হোসেনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন বর্ষা। এ তথ্য জানার পর সন্দেহ থেকে হিংসাত্মক হয়ে ওঠেন মাহীর। ‘প্রেমের’ পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে গত সোমবার দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বর্ষাদের আরমানিটোলার বাড়িতেই খুনের পরিকল্পনা সাজায় প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক। আর হত্যার আগে জোবায়েদকে ডেকে আনতে মাধ্যম বা টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয় প্রেমিকা বর্ষাকেই। জোবায়েদ হত্যায় জড়িত অভিযোগে আটক মাহীর, তার দুই বন্ধু ও পুলিশের হেফাজতে থাকা বর্ষাকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পর্যালোচনা করে গতকাল সোমবার এসব তথ্য জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট থানা ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেছেন, প্রেমের টানাপোড়েন থেকেই জোবায়েদকে হত্যা করা হয়।
এদিকে জোবায়েদ হত্যার ঘটনায় ওইদিনই রাতভর জবি শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতাকর্মীদের বিক্ষোভে উত্তাল পরিস্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে স্বজনদের চাপের মুখে মাহীরকে গতকাল সকালে সংশ্লিষ্ট বংশাল থানা পুলিশের হেফাজতে দিয়ে যান তার মা রেখা খাতুন। যদিও থানার ওসি রফিকুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত মাহীর ও তার দুই বন্ধুকে আটকের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেননি। তবে মাহীরের খালু ইমরান শেখ গতকাল বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে কালবেলাকে বলেন, ‘আজ (সোমবার) সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে মাহীরের মা তাকে নিয়ে বংশাল থানায় দিয়ে এসেছেন। এরপর থেকে মাহীর পুলিশের হেফাজতেই আছে।’
মাহীরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন ও জোবায়েদের প্রতি দুর্বলতা: আটক মাহীর ও বর্ষাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের মুঠোফোনের কললিস্ট বিশ্লেষণ করে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, প্রেমঘটিত বিষয় থেকে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। পুলিশ বলছে, মাহীর ও বর্ষার দীর্ঘদিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গত এক বছরে সেই সম্পর্কে ভাটা পড়ে। এই এক বছর ধরে বর্ষাকে গৃহশিক্ষক হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান পড়াতেন জোবায়েদ। এরই মধ্যে জোবায়েদের প্রতি বর্ষার দুর্বলতা তৈরি হয়, যা জেনে যায় মাহীর। তারপর ক্ষোভ ও হিংসার বশবর্তী হয়ে প্রতিহিংসা থেকে জোবায়েদকে শায়েস্তার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে এবং বর্ষার কাছ থেকে জোবায়েদের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য নেয়। জোবায়েদ কখন পড়াতে আসে, কোন দিক দিয়ে আসে এসব জেনে বর্ষাদের বাড়িতেই অবস্থান নেয় মাহীর। ঘটনার দিনে মাহীর-বর্ষার একাধিকবার ফোনে কথা বলার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। কাছাকাছি সময়ে, বর্ষার ফোন থেকে জোবায়েদের সঙ্গেও কথা বলার আলামত পেয়েছে পুলিশ।
হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় তিনজন, ছুরি চালায় মাহীর : গত রোববার বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটের দিকে আরমানিটোলার পানির পাম্প গলির ‘রওশন ভিলা’ নামের বাড়ির সিঁড়ি থেকে রক্তমাখা মরদেহ উদ্ধার করা হয় জোবায়েদের। খুন হওয়ার কাছাকাছি সময়ে সিসিটিভি ফুটেজে দুজন তরুণকে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে, তবে তাদের মুখ স্পষ্ট নয়। মাহীরকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, ঘটনার সময় মাহীর ও তার দুই বন্ধু ছিল। এ তিনজন ও জোবায়েদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে মাহীর ধারালো অস্ত্র দিয়ে জোবায়েদকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। বাকি দুজন জোবায়েদকে ধরে রাখে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মাহীরের হাতেও ধারালো অস্ত্রের আঘাত লাগে। এ ঘটনায় জড়িত আরও দুজন পলাতক। তাদের একজন নাফিস ও বাকি একজনের নাম জানা যায়নি।
পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে ছেলেকে থানায় দেন মা : জোবায়েদ খুনের খবরে উত্তাল হয়ে ওঠে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। তার রাজনৈতিক সংগঠন ছাত্রদল বিক্ষোভ করে ঘটনাস্থল ও ক্যাম্পাসে। এসব কারণে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে খুনিদের ধরতে অভিযানে নামে বংশাল থানা পুলিশ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) লালবাগ বিভাগ। পুলিশ ও ডিবি যৌথ অভিযানের আগে সন্দেহভাজন খুনিদের পালিয়ে থাকার সম্ভাব্য জায়গাগুলো শনাক্ত করে। এরপর মাহীরের বাড়ি রাজধানীর কদমতলী ও মাহীরের খালার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের পানগাঁও এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে থাকা একাধিক পুলিশ সদস্য বলেন, রোববার রাত ৩টায় পানগাঁওয়ে মাহীরের বড় খালার বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। সে সময় মাহীরের খালা, খালু ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে খালা ও খালু মাহীরের মাকে মোবাইল ফোনে এসব বিষয়ে জানান এবং মাহীরকে আইনের হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। সে অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সকালে ছেলেকে থানা হেফাজতে দিয়ে যান মা রেখা খাতুন। যদিও মাহীরকে পুলিশের হেফাজতে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই।’ তবে মাহীরের খালু ইমরান শেখ কালবেলাকে বলেন, ‘রোববার রাত ৩টায় আমাদের বাসায় পুলিশ এসেছিল মাহীরের খোঁজে। যদিও আমাদের বাসায় সে ছিল না। এ খবর আমরা রেখাকে (মাহীরের মা) জানাই। পরে রেখা সকালে তার ছেলেকে নিয়ে থানায় দিয়ে এসেছে।’ এ ব্যাপারে কথা বলতে মাহীরের বাবার মোবাইল ফোনে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। জানা গেছে, মাহীর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজে পড়াশোনা করছিলেন।
সার্বিক বিষয়ে পুলিশের লালবাগ বিভাগের ডিসি মল্লিক আহসান উদ্দিন বলেন, ‘সঠিক তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে, তবে তদন্তের স্বার্থে সবকিছু এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে বেশকিছু তথ্য পেয়েছি। আশা করছি আগামীকাল (আজ) সকাল ১০টার মধ্যে আপনাদের সুসংবাদ দিতে পারব।’
গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। জোবায়েদের বড় ভাই এনায়েত হোসেন সৈকত বলেন, ‘আমরা পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করতে চেয়েছি। আসামি করতে চেয়েছি শিক্ষার্থী বর্ষা, তার বাবা-মা, বর্ষার প্রেমিক মাহীর রহমান এবং মাহীরের বন্ধু নাফিসকে। কিন্তু বংশাল থানার ওসি মামলা নিতে রাজি হননি।’
এ বিষয়ে বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তারা যাদের নাম দিতে চান, আমরা সে নামেই মামলা নেব। শুধু পরামর্শ দিয়েছি, যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।’
এদিকে গতকাল দুপুর ২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ প্রাঙ্গণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও দলীয় সহকর্মীদের অংশগ্রহণে জোবায়েদের প্রথম জানাজা হয়। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন তার বাবা, ভাইসহ পরিবারের সদস্যরা। এর আগে থানা থেকে পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। বিকেলে মরদেহ নিয়ে কুমিল্লার হোমনায় কৃষ্ণপুর গ্রামের উদ্দেশে রওনা হন পরিবারের সদস্যরা। সেখানে মাগরিবের নামাজের পর তাকে দাফন করা হয়। জোবায়েদের হত্যাকাণ্ডে তার গ্রামের বাড়ি ও এলাকায় পড়েছে শোকের ছায়া। এ ছাড়া হত্যার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে হোমনা সদর উপজেলায় বিক্ষোভ করেছে স্থানীয় ছাত্রদল।
মন্তব্য করুন