যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনের গাজায় কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি বারবার লঙ্ঘন করে চলেছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। গত ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় অন্তত ৯৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ২৩০ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছে অন্তত ৪৫ জন, আর আহত হয়েছে ১৫৮ জন। এই ঘটনাকে যুদ্ধবিরতির ‘স্পষ্ট ও ঘোর লঙ্ঘন’ হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর। তারা জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অন্তত ৮০ বার লঙ্ঘন করেছে ইসরায়েল, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিকতার ঘোর লঙ্ঘন। এমন পরিস্থিতিতেও হামাসের নেতৃত্ব যুদ্ধবিরতির প্রতি তাদের পূর্ণ অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করলেও ইসরায়েলি বাহিনীর আগ্রাসন থামছে না। যুক্তরাষ্ট্রও এই হামলাকে খুব বড় কিছু নয় বলে অভিহিত করে যুদ্ধবিরতি টিকে থাকার আশা প্রকাশ করছে, যা ইসরায়েলের এমন কর্মকাণ্ডকে প্রকারান্তরে সমর্থন দিচ্ছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকেই গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলা শুরু হয়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দুই বছরের হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা এখন ৬৮ হাজার ২১৬ এবং আহত ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৬১ জন। এই ভয়াবহতার মধ্যেই সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তর ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত মিডল ইস্ট মনিটর জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গত ১০ দিনে ইসরায়েল অন্তত ৮০ বার চুক্তি ভঙ্গ করেছে।
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের দাবি-পাল্টা দাবি: হামাসের সশস্ত্র শাখা আল-ক্বাসাম ব্রিগেড জোর দিয়ে বলেছে, গাজার সব এলাকায় যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে যে চুক্তি হয়েছে, তারা তা পূর্ণ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। তারা বলছে, রাফাহ এলাকাটি সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত এবং ২০২৫ সালের মার্চে যুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে সেই অঞ্চলের ইউনিটগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাই ওই অঞ্চলগুলোতে ঘটছে এমন কোনো ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে, ইসরায়েল অভিযোগ করেছে যে হামাস ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্যবস্তু করেছে, যার জবাবে তারা হামাসের অবস্থানে হামলা চালিয়েছে। তবে গাজায় আবার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে বলেও দাবি করেছে ইসরায়েল।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর আছে, দাবি যুক্তরাষ্ট্রের: ইসরায়েলি বাহিনীর গাজার প্রাণঘাতী হামলা চালানো অব্যাহত রাখলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইসরায়েল-হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এখনো কার্যকর রয়েছে। রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প আরও ইঙ্গিত দেন, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের সঙ্গে হামাসের নেতৃত্ব জড়িত নয়; বরং ‘কিছু বিদ্রোহী’ দায়ী থাকতে পারে। তিনি বলেন, ‘যেভাবেই হোক না কেন, বিষয়টি যথাযথভাবে সামলানো হবে। কঠোরভাবে, তবে সঠিকভাবে।’ ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেন, তার মধ্যস্থতায় হওয়া এই যুদ্ধবিরতি টিকে থাকবে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স নতুন করে এই সহিংসতাকে ‘খুব বড় কিছু’ মনে করছেন না। তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতিতে ‘উত্থান-পতন’ থাকবে এবং এটি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ সুযোগ তৈরি করেছে। ভ্যান্স আরও জানান, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ইসরায়েল সফর করবেন।
দুটি ক্রসিং দিয়ে আবার ত্রাণের ট্রাক ঢুকতে দিচ্ছে ইসরায়েল: গাজার দুটি ক্রসিং কেরেম আবু সালেম (ইসরায়েলে কেরেম শালোম) ও আল-কারারা (ইসরায়েলে কিসুফিম) দিয়ে খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী বহনকারী কয়েক ডজন ট্রাককে গাজায় প্রবেশ করতে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। অতি সম্প্রতি বিমান হামলা চালানোর আগে ইসরায়েল এই ক্রসিংগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে গাজা ও মিশরের মধ্যে অবস্থিত রাফা ক্রসিং এখনো বন্ধ রয়েছে, যা শুধু সাহায্য প্রবেশই নয়, বরং আহত ও অসুস্থ ফিলিস্তিনিদের চিকিৎসার জন্য সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি করছে।
কায়রোতে বৈঠকে বসছে হামাসের প্রতিনিধিদল: গাজার যুদ্ধবিরতি নিয়ে সৃষ্ট নাজুক পরিস্থিতি এবং এই প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে আলোচনা করতে কায়রোতে কাতার ও মিশরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে হামাসের একটি প্রতিনিধিদল। আলোচ্যসূচিতে রোববার গাজায় ইসরায়েলের চালানো ‘ডজনখানেক বিমান হামলায়’ নিহতদের বিষয়টিও থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। হামাস কর্মকর্তা খলিল আল-হাইয়ার নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল মিশরীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আসন্ন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার সংলাপ নিয়েও আলোচনা করবে, যে সংলাপের লক্ষ্য ফিলিস্তিনি দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা।
হামাসকে নিরস্ত্রীকরণে নিরাপত্তা কাঠামো তৈরির আহ্বান ভ্যান্সের: যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বন্দি ও জিম্মি বিনিময়ের পাশাপাশি গাজা পুনর্গঠনের জন্য একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী রূপরেখার প্রস্তাবও রয়েছে। যদিও এর বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স শান্তিচুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে হামাসকে নিরস্ত্র করার জন্য পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোকে একটি ‘নিরাপত্তা কাঠামো’ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হামাসকে নিরস্ত্র করার জন্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলো এবং আমাদের মিত্ররা এখনো নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করেনি।’
মন্তব্য করুন