আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য পৃথক প্রার্থী তালিকা তৈরি করছেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী দেন তিনি। অন্যদিকে পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরও ৩০০ আসনে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার পাশাপাশি ঢাকা-১৭ আসনেও প্রার্থী দেন। উভয়পক্ষের প্রার্থীই লাঙ্গল প্রতীক চেয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেন। এরপরই ‘লাঙ্গল’ প্রতীক কার, তা নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়। গতকাল রোববার রওশনের প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিলের মধ্য দিয়ে এই আলোচনার আপাতত সমাধান মিলেছে। অর্থাৎ লাঙ্গলের লড়াইয়ে জয়ী হয়েছে জি এম কাদেরের পক্ষ।
লাঙ্গল প্রতীক পেয়েছেন জি এম কাদেরের প্রার্থী মেজর (অব.) আনিছুর রহমান। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ঢাকা জেলার জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন খান এ কথা জানান। আগামী ১৭ জুলাই এই আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উপনির্বাচনে রওশন এরশাদ প্রার্থী করেছিলেন কাজী মামুনুর রশীদকে। এই আসনে মোট ১৫ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। তাদের মধ্য সাতজনকে বৈধ ঘোষণা করা হয়।
জাতীয় পার্টি ও নির্বাচন কমিশনের নেতারা জানান, দলের গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা করে জাপার আনিছুর রহমানকে বৈধ প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান। নিয়ম অনুযায়ী, পার্টির মনোনয়ন বোর্ডের সভা ডেকে জি এম কাদের প্রার্থী দিয়েছেন, যা রওশনের প্রার্থীর ক্ষেত্রে হয়নি। অর্থাৎ পদে পদে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। তাই কাজী মামুনের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে।
তবে এ ঘটনা শেষ পর্যন্ত আদালতেও গড়াতে পারে। কাজী মামুন ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের কাছে আপিল করবেন।
প্রয়োজনে আদালতে যেতেও প্রস্তুত।
জানতে চাইলে জি এম কাদেরের উপদেষ্টা মনিরুল ইসলাম মিলন কালবেলাকে বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি মনোনয়ন বোর্ডের সভা ডেকে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত অনুযায়ি ঢাকা-১৭ আসনে প্রার্থী দিয়েছেন। তিনি ছাড়া জাতীয় পার্টির পক্ষে আর কারও মনোনয়ন দেওয়ার বৈধতা নেই। নির্বাচন কমিশন গঠনতন্ত্র বিচার বিশ্লেষণ করে আমাদের প্রার্থীকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সত্য ও ন্যায়ের জয় হয়েছে।
পার্টি সূত্রে বলছে, ইসিতে দল ও প্রতীকের নিবন্ধন জি এম কাদেরের নামে। তাই জাতীয় পার্টির পক্ষে অন্য কোনো নেতার স্বাক্ষরে কোনো নির্বাচনেই প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ হতে পারে না। দলের প্রতীক নিয়ে রওশনের সঙ্গে মামলারও নিষ্পত্তি হয়েছে বহু আগে।
এবার প্রশ্ন উঠেছে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে তাহলে রওশনপন্থিরা কি আলাদা প্রার্থী দেবেন, নাকি ঢাকা-১৭ আসনে তাদের প্রার্থী অবৈধ হওয়ায় এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসবে তারা। এ ব্যাপারে রওশনপন্থি চারজন নেতার সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তারা বলেন, দ্রুত রওশনের নেতৃত্বে জাপার কাউন্সিল হবে। কাউন্সিলে জি এম কাদেরকে বাদ দিয়ে গঠন করা হবে কমিটি। যার চেয়ারম্যান হবেন রওশন এরশাদ। প্রয়োজনে ‘জাতীয় পার্টি’ আগে-পরে কোনো নাম দিয়ে দলের নিবন্ধন নিশ্চিত করা হবে।
তারা বলেন, কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতারা আর জি এম কাদেরের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল নন। তারা রওশনের পক্ষে যোগ দিতে চান। কেন্দ্রীয় অনেক নেতাকে অন্যায়ভাবে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে নতুন করে দলের নিবন্ধন নেওয়ার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে নেতারা বলেন, আমরা চেষ্টা করব। সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।
রওশনপন্থি নেতা অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, আমরা পিছিয়ে যেতে চাই না। দ্রুত সম্মেলনের আয়োজন করে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে এগিয়ে যাবে।
দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বের কোন্দল নিয়ে রওশন ও জি এম কাদেরের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই চলছে।
সরকার জি এম কাদেরের চেয়ে রওশন এরশাদকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। সম্প্রতি জাপার সংসদীয় দল ও প্রেসিডিয়াম সদস্যরা রওশন এরশাদের জায়গায় জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সংসদের স্পিকার বরাবর আবেদন করলেও সেটি কার্যকর করা হয়নি। রওশন এরশাদ সরকারের সঙ্গে থেকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চান। জি এম কাদের চান বিএনপির সঙ্গে হাত মিলানোর পাশাপাশি সরকারের কঠোর সমালোচনায় মুখর থেকে জনসমর্থন বাড়াতে।
সম্প্রতি জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালনের ওপর আদালতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে যে মামলা হয়, সেটির পেছনেও নেতৃত্বের কোন্দল মূল দায়ী বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। রওশন চাইছেন প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে সরকারের সঙ্গে থাকতে। কারণ বিএনপি নির্বাচনে না গেলে অনেকের সংসদ সদস্য হওয়া সহজ হবে এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে।
জাপার নেতারা বলছেন, তাদের দুই শীর্ষ নেতাকে ঘিরে যে বিভক্তি তৈরি হয়েছে, তাতে দলের ভেতরে-বাইরে হোঁচট খাচ্ছে জাপা। ইতোমধ্যে নেতাকর্মীরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছেন। অনেকেই দল ত্যাগ করছেন।
দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত এইচ এম এরশাদের সময় থেকেই জাপায় এই বিভাজন চলে আসছে। এরশাদ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। কিন্তু রওশন এরশাদ দলের নেতাদের একটি অংশকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন, পরবর্তী সময়ে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন। এখনো দলে সেই বিভাজন আছে। এরই ধারাবাহিকতায় রওশনপন্থি নেতা মসিউর রহমানকে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদ থেকে সরিয়ে ফখরুল ইমামকে স্থলাভিষিক্ত করতে স্পিকারের কাছে জি এম কাদেরের আবেদনও ঝুলে আছে।
জানতে চাইলে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু কালবেলাকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আমরা বৈধ। গঠতন্ত্র মেনে ২০১৯ সালে কাউন্সিল হয়েছে। কমিটি হয়েছে। তৃণমূলের সুপারিশ ও মনোনয়ন বোর্ডেও সভা শেষে দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের স্বাক্ষরে আমরা একের পর এক নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। প্রার্থী দিচ্ছি। এখন হঠাৎ করে একজনের বাড়ি অন্যজন দাবি করলে তো হবে না।
ঢাকা-১৭ আসনে রওশন এরশাদের পক্ষে প্রার্থী দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা তারা না বুঝে করেছে। লাঙ্গল চাইলেই তো যে কারও হয়ে যাবে না। হতে পারে না। এজন্য একটা নিয়ম-নীতির বিষয় আছে।
মন্তব্য করুন