

রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ গঠন ঘিরে তৈরি হয়েছে ত্রিমুখী সংকট। প্রস্তাবিত নতুন কাঠামো নিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিরোধিতায় পরিস্থিতি এখন জটিল আকার ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই রাজপথে শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল অনুসরণ করে ক্যাডার পদ হারানোর আশঙ্কায় বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকরাও আছেন আন্দোলনে। এর পাশাপাশি সাত কলেজকে চারটি স্কুলে ভাগ করে পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা নিয়েও আছে আপত্তি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, রাজধানীর সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রস্তাবনার ওপর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়ে একটি খসড়া আইন প্রস্তুত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত আইনের ওপর মতামত নিতে এরই মধ্যে জনপ্রশাসন, অর্থ, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ, তথ্য, স্বরাষ্ট্র এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি—এই পাঁচ মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মতামত পাওয়ার পর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে খসড়াটি পর্যালোচনা করা হবে। সেখান থেকে তৈরি চূড়ান্ত খসড়া আইন পাঠানো হবে আইন মন্ত্রণালয়ে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে এটি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য যাবে। প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন মিললেই অধ্যাদেশ জারির জন্য খসড়াটি পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতির কাছে। তবে আইনের খসড়া নিয়ে চরম আপত্তি তুলেছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। এর মধ্যে দ্রুত অধ্যাদেশ জারির দাবিতে রোববার শিক্ষা ভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। আরেকটি অংশ ‘স্কুলিং মডেলের’ বিরোধিতা করে চালাচ্ছে আন্দোলন। অন্যদিকে, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলছেন, সাত কলেজে শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় ১৫০০টি পদ রয়েছে। এর বাইরে সংযুক্ত, এনসিটু হিসেবে আরও ২ হাজার শিক্ষক এখানে পাঠদান করান। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ হবে সিলেকশন বোর্ডের মাধ্যমে, যেমনটি হয়েছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাতটি কলেজ বড় হওয়ায় এখানে অধ্যাপকদের পদও বেশি। নতুন নিয়মে এসব পদও বিলুপ্ত হবে। এই প্রেক্ষাপটে তারা অ্যাফিলিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি জানিয়েছেন। যাতে তাদের ক্যাডার পদ অক্ষুণ্ন থাকে।
আন্তঃমন্ত্রণালয়ের পাঠানো খসড়া থেকে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কমর্চারী নিয়োগ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে। অর্থাৎ নিয়োগ কার্যক্রমটি সম্পূর্ণ হবে তিনটি সিলেকশন বোর্ডের মাধ্যমে। শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি থাকবেন ভিসি। দশম গ্রেড বা তার ঊর্ধ্বে কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডের সভাপতিও থাকবেন ভিসি। আর ১১ থেকে ২০তম গ্রেডের জন্য বোর্ডের সভপতি থাকবেন প্রো-ভিসি। অর্থাৎ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে শিক্ষক নিয়োগ দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। তাহলে শিক্ষা ক্যাডারের পদগুলো অটোমেটিক বিলুপ্ত হবে। এ নিয়ে গত দুই মাস ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন করছেন শিক্ষকরা।
সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক মাহফিল আরা বেগম কালবেলাকে বলেন, সরকার বিশ্ববিদ্যালয় করুক, কোনো অভিযোগ নেই, আমাদের দাবি—এই শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য যেন নষ্ট না হয়। এ ছাড়া কলেজগুলোতে শিক্ষা ক্যাডারের পদ যেন বিলুপ্ত না হয়।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার অ্যাসোসিয়শেনের সভাপতি অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল বলেন, আমাদের উদ্বেগের কথা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। এখন দেখতে চাই কী করে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই নানা সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকটের মূল কারণ দ্রুত অধ্যাদেশ না হওয়া, শিক্ষা ক্যাডারের পদ বিলুপ্ত হওয়ার শঙ্কা ও কাঠামোগত সমস্যা। অধ্যাদেশ জারি না হওয়ায় বর্তমান শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন থমকে আছে। মাঝামাঝি অবস্থানে থাকায় তাদের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সেশনজটে পড়তে হতে পারে। সাত কলেজকে স্কুলিং কাঠামোতে যেমন চারটি স্কুলে বিভক্ত করে আনার প্রস্তাবেও শিক্ষার্থীরা তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এতে কলেজের ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হবে এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়বে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহবুবুল হক পাটওয়ারী কালবেলাকে বলেন, সবার সংকট ও উদ্বেগের কথাগুলো বিবেচনা নিয়েই আমরা কাজ করছি। এই কলেজগুলোতে শিক্ষা ক্যাডারের পদ যেন বিলুপ্ত না হয়, সেটা আমাদের বিবেচনায় আছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের যত দাবি-দাওয়া আছে, সবগুলো অ্যাড্রেস করতে কাজ করছি।
খসড়া আইনে যা আছে
সার্চ কমিটিতে হবে ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগ: নিয়োগের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার নিয়োগ হবে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। আচার্যের মতামতের ভিত্তিতে কমিশন একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে ভিসি-প্রো-ভিসি নিয়োগ দেবেন। চার বছরের জন্য নিয়োগ পাবেন তারা। তবে ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার হিসেবে একজন দুই মেয়াদের বেশি নিয়োগ পাবেন না। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ১৭টি দায়িত্ব পালন করবেন ভিসি। প্রো-ভিসি চারটি এবং ট্রেজারায় ৯টি দায়িত্ব পালন করবেন।
নিয়োগে স্বচ্ছতায় পৃথক সিলেকশন বোর্ড: সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে থাকবে পৃথক পৃথক সিলেকশন বোর্ড। বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, শিক্ষক ও বিভিন্ন গ্রেডের কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগে ভিন্ন কাঠামোর বোর্ড নিয়োগ সুপারিশ করবে। প্রতিটি সিলেকশন বোর্ডের কার্যাবলি সংবিধি অনুযায়ী পরিচালিত হবে। বোর্ডের দেওয়া নিয়োগ-সুপারিশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে সিন্ডিকেটের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। যদি সিন্ডিকেট কোনো সুপারিশের সঙ্গে একমত না হয়, তাহলে বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনে পাঠাতে হবে। কমিশনের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
শিক্ষক নিয়োগে সিলেকশন বোর্ডের সভাপতি হবে ভিসি। বোর্ডে থাকবেন প্রো-ভিসি, আচার্য কর্তৃক মনোনীত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুজন বহিরাগত পিএইচডিধারী বিশেষজ্ঞ, সিন্ডিকেট কর্তৃক মনোনীত একজন ডিসিপ্লিন কো-অর্ডিনেটর (অধ্যাপক পদমর্যাদার নিচে নন)। তবে উপাচার্যের পদ শূন্য থাকলে বোর্ড পরিচালনা করবেন উপ-উপাচার্য। এ ছাড়া দশম গ্রেড ও এর উপরের কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডে উপাচার্য সভাপতি থাকবেন। সদস্য থাকবেন ট্রেজারার, একাডেমিক কাউন্সিল একজন হেড অব স্কুল, সিন্ডিকেট কর্তৃক মনোনীত একজন বিশেষজ্ঞ ও রেজিস্ট্রার সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আর ১১তম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত কর্মচারী নিয়োগে বোর্ডে প্রো-ভিসি সভাপতি, একাডেমিক কাউন্সিল মনোনীত একজন হেড অব স্কুল, সংশ্লিষ্ট ডিসিপ্লিন কো-অর্ডিনেটর বা দপ্তর প্রধান ও সিন্ডিকেট কর্তৃক মনোনীত একজন প্রতিনিধি ও উপাচার্য কর্তৃক মনোনীত একজন বিশেষজ্ঞ থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারকিতে থাকবে কমিশন: সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির মানোন্নয়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং বিশ্ববিদ্যালয় তদারকির জন্য গঠিত হবে একটি স্বতন্ত্র কমিশন। এক বা একাধিক সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত এ কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে কাজ করবে। কমিশনের থাকবে ব্যাপক ক্ষমতা ও দায়িত্ব। এর আওতায় নিয়মিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন ও অবকাঠামো, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার ও যন্ত্রপাতি, সহযোগী প্রতিষ্ঠান, পরীক্ষার আয়োজন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষাদানসহ সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম পরিদর্শন করা হবে। যে কোনো পরিদর্শন বা মূল্যায়নে যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে আগেই জানাবে কমিশন। পরিদর্শন শেষে কমিশন তাদের মতামত ও সুপারিশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানাবে। প্রয়োজন মনে হলে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অনিয়ম বা অভিযোগ পাওয়া গেলে কমিশন আকস্মিক পরিদর্শনও করতে পারবে। তদন্ত শেষে প্রাপ্ত প্রতিবেদন সরকারকে দেবে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়টি ১০টি বডির মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এর মধ্যে রয়েছে সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল, কমিটি অব স্কুল হেডস, স্কুল কো-অর্ডিনেশন কমিটি, স্কুল, অর্থ কমিটি, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটি, সিলেকশন বোর্ড, শৃঙ্খলা কামিটি এবং সংবিধি অনুসারে গঠিত অন্যান্য কমিটি।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষা পদ্ধতি ও কাঠামোগত বিন্যাসে আনা হচ্ছে বড় পরিবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সাতটি কলেজকে চারটি ভিন্ন ‘স্কুল’-এ ভাগ করা হবে। এর মধ্যে স্কুল অব সায়েন্সেস পরিচালিত হবে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজে। এখানে পড়ানো হবে ফলিত গণিত, প্রাণিবিদ্যা, ডেটা সায়েন্স, প্রাণরসায়ন, ফিজিক্স, ফলিত রসায়ন, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ফরেনসিক সায়েন্স, মনোবিজ্ঞান ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ সরকারি বাঙলা কলেজে পরিচালিত হবে। এখানে পড়ানো হবে সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ, উন্নয়ন অধ্যয়ন, অর্থনীতি, ফিল্ম স্টাডিজ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও স্কুল অব বিজনেস স্টাডিজ। তিতুমীর কলেজে অ্যাকাউন্টিং, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, হোটেল ও হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং ও সেলস, ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স ম্যানেজমেন্ট, স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিস কবি নজরুল সরকারি কলেজে এবং সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে পড়ানো হবে আইন, ক্রিমিনোলজি বিভাগ।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হাইব্রিড শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু হবে। শিক্ষাদান পদ্ধতিতে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ক্লাস হবে ভার্চুয়াল বা অনলাইন পদ্ধতিতে, আর বাকিগুলো ক্লাসরুমে সশরীরে অনুষ্ঠিত হবে। তবে সব পরীক্ষাই সশরীরে আয়োজন করা হবে। শিক্ষাপদ্ধতি হবে ইন্টারডিসিপ্লিনারি। স্নাতক পর্যায়ের প্রথম চারটি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীদের সাধারণ বা মৌলিক বিষয়গুলো পড়ানো হবে এবং পরবর্তী চারটি সেমিস্টারে ডিসিপ্লিনভিত্তিক বিশেষজ্ঞ বিষয় পড়ানো হবে।
খসড়া অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়টি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন সব দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এ ছাড়া, দরিদ্র, মেধাবী ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বৃত্তি বা শিক্ষা সাহায্য প্রদানের জন্য এক বা একাধিক ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করার সুযোগ থাকবে।
মন্তব্য করুন