

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় অন্তত ২৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ জমি দীর্ঘদিন ধরে বেদখল হয়ে আছে। এতে পাঠদান, অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ব্যাহত হচ্ছে।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, কাশিয়ানীতে মোট ১৭১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ১১১টি সরকারি এবং ৫৩টি জাতীয়করণকৃত। সরকারি ১১টি বিদ্যালয়ের নিজস্ব জমি নেই; খাসজমির ওপর স্থাপিত। পাশাপাশি ২৫টি বিদ্যালয়ের নিজস্ব জমি থাকলেও প্রায় আট বিঘা জমি এখন বেদখলে। অথচ জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়গুলোর ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ জমি বরাদ্দের নিয়ম রয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে জমি দেওয়া হয়েছিল চাকরি পাওয়া, সভাপতি হওয়া বা স্থানীয় প্রভাব খাটানোর বিনিময়ে; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই জমিদাতাদের উত্তরসূরির দখলে চলে গেছে, যাদের কেউ কেউ ওই জায়গায় ঘরবাড়ি, দোকান, মসজিদ, মাদ্রাসা, পুকুর এমনকি কবরস্থান পর্যন্ত তৈরি করেছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, অনেক বিদ্যালয়ের জমিতে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। যেমন দোকানঘর, রান্নাঘর, ঈদগাহ, টিনের ঘর, টয়লেট ইত্যাদি। কোথাও আবার বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও গড়ে উঠেছে।
অবৈধ দখলের কারণে কিছু বিদ্যালয় অন্যত্র সরে গিয়ে নামমাত্র স্থানে চলছে। কোথাও ভবনের বরাদ্দ থাকলেও জমির অভাবে নির্মাণ সম্ভব হয়নি। শিক্ষকরা থাকলেও শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে। পাঠদানে বিঘ্ন ঘটছে।
বর্ষাকালে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে যেতে হয় ভেলা, নৌকা বা সাঁকো দিয়ে। কোথাও আবার ক্লাসের পাশেই টয়লেটের খোলা ট্যাংকি। দুর্গন্ধে জানালা বন্ধ করে ক্লাস নিতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি কর্তৃপক্ষের নজরদারির ঘাটতির অভিযোগ তুলেছেন বিদ্যালয় পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা উত্তম কুমার সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘কিছু সরকারি স্কুলের জমি বেদখলে রয়েছে। আমরা জেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানাব। এরই মধ্যে কিছু মামলা হয়েছে। আরও জমি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। যারা দখলে রেখেছে, তারা আমাদের অনুমতি নেয়নি বা জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি।’
বেদখলের চিত্র: ২৫টি বিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বেদখল চিত্র দেখা যায়—১৪৮ নম্বর চন্দ্রদ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ৩৩ শতাংশ জমির মধ্যে ২৩ শতাংশ বেদখলে। প্রধান শিক্ষক মনিরা খানম বলেন, ‘অনেকবার বলেও জমি মুক্ত করা যায়নি। পুরো খাজনা দিচ্ছি, অথচ জায়গা পাচ্ছি না।’
৩৮ নম্বর পশ্চিম রাতইল বিদ্যালয়: ৮৭ শতাংশ জমির মধ্যে ২১ শতাংশ দখল করে গড়ে উঠেছে মাদ্রাসার টিনশেড ঘর ও টয়লেট। দুর্গন্ধে পাঠদান সম্ভব নয় বলে জানান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. কামরুজ্জামান।
পিংগলিয়া ২৯ নম্বর বিদ্যালয়: ৩১ শতাংশ জমির মধ্যে ২৫ শতাংশ দখল করে গড়ে উঠেছে মাদ্রাসার মার্কেট ও ভবন। প্রধান শিক্ষক আঞ্জুমান আরা জানান, জমি মিউটেশন হয়ে গেছে, মামলা চলছে।
২৭ নম্বর কাশিয়ানী মডেল বিদ্যালয়: ৩৫ শতাংশ জমির মধ্যে ১০ শতাংশ বেদখলে। শিক্ষক কামরুল ইসলাম জানান, ৪২০ শিক্ষার্থীর স্কুলে খেলাধুলার জায়গা নেই। অথচ জমি মুক্ত করা যাচ্ছে না।
৪০ নম্বর তিতাগ্রাম শিবপুর বিদ্যালয়: ৩৭ শতাংশ জমির মধ্যে ১১ শতাংশ দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে দোকানঘর। প্রধান শিক্ষক রিনা খানম বলেন, জেলা প্রশাসক সাত দিনের সময় দিয়েছিলেন; কিন্তু জমি দখলমুক্ত করা যায়নি।
একইভাবে ১০২ নম্বর পশ্চিম দেবাসুর বিদ্যালয়ের ৩৩ শতাংশ জমির মধ্যে ৭ শতাংশ বেদখলে, ৪৫ নম্বর আড়ুয়াকান্দি বিদ্যালয়ের ৪৫ শতাংশ জমির মধ্যে ২২ শতাংশ বেদখলে। ১১৪ নম্বর খাগড়াবাড়িয়া বিদ্যালয়ের ২৮ শতাংশ জমির প্রায় পুরোটাই বেদখলে। ১০১ নম্বর পূর্বপুইশুর বিদ্যালয়ের ৩৩ শতাংশের মধ্যে ৫ শতাংশ দখল করে গোয়ালঘর ও চালকল নির্মাণ করা হয়েছে। শব্দে পাঠদান ব্যাহত হয়।
একইভাবে ১০৪ নম্বর শিতারামপুর বিদ্যালয়, ৬০ নম্বর ঘোনাপাড়া বিদ্যালয়, ৯০ নম্বর কড়িগ্রাম বিদ্যালয়, সাজাইল ১১ নম্বর বিদ্যালয়, ১৭ নম্বর পদ্মবিলা বিদ্যালয়, ৩৫ নম্বর রাইতকান্দি বিদ্যালয়, ৩৭ নম্বর বাগঝাপা বিদ্যালয়, ১৫১ নম্বর ছোট পারুলিয়া বিদ্যালয়, ১১৯ নম্বর ভাদুলিয়া বিদ্যালয়, ৩২ নম্বর বিশ্বনাথপুর বিদ্যালয়, ৪১ নম্বর বালিয়াডাঙ্গা বিদ্যালয়, ১১১ নম্বর সাফলীডাঙ্গা বিদ্যালয়, ৬৯ নম্বর রাজপাট বিদ্যালয়, ১০৩ নম্বর সিল্টা বিদ্যালয়, ২২ নম্বর চাপ্তা বিদ্যালয়ের জমি বেদখলে রয়েছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জ্যোৎস্না খাতুন বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় যত দ্রুত সম্ভব বেদখল জমিগুলো চিহ্নিত করে উদ্ধার করার পদক্ষেপ নিচ্ছি।’
মন্তব্য করুন