

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতার এই পঙ্ক্তি যেমন মানবসমতার আহ্বান জানায়, তেমনই ইঙ্গিত করে মানুষে মানুষে বিদ্যমান বৈষম্যের বাস্তবতাকে। যুগে যুগে সভ্যতার উন্নয়ন সত্ত্বেও মানুষের অধিকার আজও প্রশ্নের মুখে। জাতিসংঘের মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রেও বলা হয়েছে—‘সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, জন্মের পর থেকেই নানা বৈষম্যের শিকার হয় মানুষ।
মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে এবং বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের সুরক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। এই ঘোষণার মাধ্যমে মানবাধিকারের অধিকারকে সর্বজনীন ও সবার জন্য সমান বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়—জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে। ঘোষণাপত্রের ৩০টি অনুচ্ছেদে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই দিনটিকে স্মরণে রেখে প্রতি বছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয় বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য—‘আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভিত্তি হোক মানবাধিকার।’ দিবস উপলক্ষে সরকারসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
দিবসটি উপলক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাণী দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ বছরের প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মৌলিক অধিকার হারানো নির্যাতিত মানুষের প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোথাও যেন ভবিষ্যতে আর কেউ মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, সেজন্য মানবাধিকার রক্ষা আমাদের প্রতিদিনের জন্য অপরিহার্য।’
সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গণপিটুনি, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, কারা হেফাজতে মৃত্যু ইত্যাদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন অধিকার সংগঠন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ২০টি, জেলহাজতে মৃত্যু হয়েছে ৬৪ জনের। রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটেছে ৩৮৩টি, এতে ৪৪৭৬ জন আহত এবং ৯৮ জন নিহত হয়েছেন। একই সময়ে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিহত হয়েছেন ২৮ জন বাংলাদেশি।
২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৪ জনে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ৭৮ জন, চট্টগ্রামে ৩২, খুলনায় ১৯, বরিশালে ১৫, রাজশাহীতে ১৪, রংপুরে ১২, ময়মনসিংহে ১০ এবং সিলেটে ৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানান আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গত ১৫ মাসে সারা দেশে ৪৭৬টি ঘটনায় ১০৭৩ জন সাংবাদিক হামলা, মামলা, হয়রানি, হুমকি, গ্রেপ্তার, চাকরি থেকে বরখাস্ত, কিংবা পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলার শিকার হয়েছেন।
টিআইবির উপ-সমন্বয়কারী জাফর সাদিক জানান, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ ১৬ ধাপ এগিয়ে ১৪৯তম অবস্থানে রয়েছে। তবে এখনো সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি। আগের নেতিবাচক অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব হলেও আশার কিছু ইঙ্গিত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
এদিকে, মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সরকারের প্রতি ১৫ দফা দাবি জানিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা, আটক বা গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ, মিথ্যা মামলার অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তি, নাগরিকদের শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত, ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতা দেখানো এবং বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা, ধর্মীয় বা মতাদর্শিক ভিন্নতার কারণে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় বাধা দেওয়া বন্ধ করা, তাওহিদি জনতার নামে সংঘটিত মব সন্ত্রাস ও হামলার ঘটনার বিচার নিশ্চিত প্রভৃতি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে পরিচালনার পরিবেশ নিশ্চিত করতেও দাবি জানিয়েছে আসক। এ উপলক্ষে সংগঠনটি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে মানববন্ধনের আয়োজন করেছে। অন্যদিকে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ অধিকার কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে।
দিনটি উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘মানবাধিকারকে বিশ্বাসের অংশ হিসেবে প্রচার করতে হবে, যাতে প্রতিটি মানুষের জীবন সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে—যে জীবনে বৈষম্যের স্থান নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাব।’
এদিকে, মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে সরকার ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (সংশোধন), ২০২৫’ শীর্ষক অধ্যাদেশ জারি করেছে। এতে নির্যাতন প্রতিরোধ এবং স্বাধীনতাবঞ্চিত ব্যক্তিদের সুরক্ষা নিশ্চিতে ‘জাতীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিভাগ’ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে।
এই বিভাগ কারাগার, থানা, হাজতখানা, সেফ হোম, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র, মানসিক হাসপাতালসহ বিভিন্ন আটক কেন্দ্র নিয়মিত এবং পূর্ব ঘোষণা ছাড়া পরিদর্শন করতে পারবে।
এ ছাড়া বিভাগের থাকবে অবাধ তথ্যপ্রবেশাধিকার—রেজিস্টার, নথিপত্র, বন্দিদের অবস্থা, পরিচয়সহ সব প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহের সুযোগ। প্রয়োজনে বন্দিদের একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার এখতিয়ারও তাদের থাকবে।
কমিশনের প্রতি সুপারিশ করা, বাস্তবায়ন তদারকি, এবং জাতিসংঘের নির্যাতন প্রতিরোধবিষয়ক সাব-কমিটি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগও থাকবে এই বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে।
মন্তব্য করুন