

উপযুক্ত প্রার্থী থাকলেও সারা দেশে রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে সহযোগী অধ্যাপকের পদ শূন্য রয়েছে ১৭টি। একই পদে মেডিকেল অনকোলজি বিষয়ে উপযুক্ত চিকিৎসক থাকলেও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের ‘স্বেচ্ছাচারী’ আচরণে আটশর বেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। গত ১১ ডিসেম্বর নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হওয়ায় বঞ্চিতদের পদোন্নতি এক ধরনের অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বঞ্চিত চিকিৎসকরা বলছেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় চিকিৎসকদের পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। কাউকে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে প্রমার্জনা দিয়ে দুটি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আবার সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক চিকিৎসককে পদোন্নতিবঞ্চিত রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা বঞ্চনার কারণ জানতে চাইলে মন্ত্রণালয় থেকে রিভিউ আবেদন করতে বলেছে। এরই মধ্যে আট শতাধিক চিকিৎসক রিভিউ আবেদন করেছেন। এতে কোনো কাজ হবে কি না, সেটা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার নামে স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়েছেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রিভিউ আবেদন জমা দিতে মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের ১ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। সেই হিসাবে রিভিউ আবেদন গ্রহণের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি গ্রুপ পদোন্নতি বঞ্চিত চিকিৎসকদের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এক সহকারী অধ্যাপক বলেন, ‘নির্দিষ্ট ব্যক্তি এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা না দিলে রিভিউ আবেদন জমা নেওয়া হয় না।’
আরেক চিকিৎসক বলেন, ‘রিভিউ আবেদন নিয়ে একজন অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি নির্দিষ্ট স্থানে জমা দিতে বলেন। রিভিউ করলে কী হবে জানতে চাইলে ওই অতিরিক্ত সচিব বলেন, এটা পুলিশের বিশেষ শাখায় দেওয়া হবে। তারা অনুসন্ধান করে দেখবে বাদ পড়াদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কি না।’
গত ১৫ বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়মমাফিক পদোন্নতি দেওয়া শুরু হয়। অধ্যাপক পদে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) এবং বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির মাধ্যমে সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক পদে ২০১৭ থেকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছিল। এ পদোন্নতিগুলোয় বিসিএস জ্যেষ্ঠতা ও মেধাক্রম অনুসারে দলমত নির্বিশেষে পদোন্নতি প্রদান করা হয়।
প্রাথমিকভাবে সরকারি চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী চাকরি স্থায়ীকরণ, সিনিয়র স্কেল পাস ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন হয়েছে এমন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি তালিকা (ফিট লিস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ২০২৪ সাল থেকে হালনাগাদ করা হয়। যারা এরই মধ্যে বেতন স্কেলে ষষ্ঠ গ্রেড অতিক্রম করেছেন, তাদের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে না। সেই হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সুপার নিউমারারি পদ সৃজনের পদক্ষেপ নেয়। যেখানে সব বিসিএসের (স্বাস্থ্য) চিকিৎসকরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়দুর রহমান গত ফেব্রুয়ারিতে জানান, প্রায় সাড়ে সাত হাজার সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করা হবে।
সহকারী অধ্যাপক হিসেবে সুপার নিউমারারি পদোন্নতিতে কোনো নির্দিষ্ট বিসিএসকে সীমানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। চলতি বছরের মার্চে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আশ্বস্ত করেন। ওই সময়ে জানানো হয়, যেসব চিকিৎসক পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন, তারা বিধিমালা অনুযায়ী যে বিসিএসেরই হোক, পদোন্নতি পাবেন। সে অনুযায়ী শূন্য পদে যোগ্য চিকিৎসকদের যথারীতি ৩৭ বিসিএস পর্যন্ত পদেদান্নতি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি সুপার নিউমারারির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শুধু ৩৩ বিসিএস পর্যন্ত চিকিৎসকদের পদন্নতি দেওয়া হচ্ছে। গাইনিতে সহকারী অধ্যাপকের সুপার নিউমারারি পদ সৃজন করা হয় ৯২০টি, যেখানে পদোন্নতি দেওয়া হয় ৫৯৯ জনকে, পদ শূন্য ছিল ৩২১টি। তার মধ্যে শেষ সাত জন ছিলেন ৩৪ ও পরবর্তী বিসিএসের। অজ্ঞাত কারণে পরের সাতজনের পদোন্নতি বাতিল করা হয়েছে।
কার্ডিওলজিতে সহকারী অধ্যাপক সুপার নিউমারারি সৃজিত পদ ২৩৩টি, পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ১৫৭ জন, শূন্য আছে ৭৬টি। পেডিয়াট্রিকসে (শিশু) সহকারী অধ্যাপক সুপার নিউমারারি পদে সৃজিত পদ ৩৯২টি, পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ২৭৯ জনকে, শূন্য আছে ১১৩টি। সার্জারিতে সহকারী অধ্যাপক সুপার নিউমারারি সৃজিত পদ ২৫৮টি, পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ১৬৫ জনকে, শূন্য আছে ৯৩টি। অন্য বিষয়গুলোতেও সৃষ্ট সুপার নিউমারারি পদের বিপরীতে ফিট লিস্টে সব বিসিএস মিলিয়ে পদোন্নতিযোগ্য চিকিৎসকের সংখ্যা কম। কিন্তু উপযুক্ত কারণ ছাড়াই ৩৪ ও পরবর্তী বিসিএসের পদন্নোতিযোগ্য চিকিৎসকদের বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রায় দেড় হাজার পদ ফাঁকা থাকবে, যা আগামী বছরের জুনের মধ্যে পূর্ণ না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হবে। এদিকে, ৩৪ ও পরবর্তী বিসিএসে সব বিষয় মিলিয়ে পদোন্নতিযোগ্য চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র দুইশ।
এ প্রসঙ্গে ৩৪, ৩৫ বিসিএসের ১২ জন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছে কালবেলা। তারা জানিয়েছেন, ৩৪ ও পরবর্তী বিসিএসের সব বিশেষজ্ঞ চিকিসককে পদোন্নতি বঞ্চিত করার কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে চরম অব্যবস্থাপনার আরেকটি উদাহরণ।
গত তিন মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক পদে প্রায় ১৪শ চিকিৎসককে পদোন্নতি দেয়। এ পদোন্নতিগুলোয় বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসের নিয়ম ভঙ্গ করে ৮৭৯ জন চিকিৎসককে পদোন্নতি বঞ্চিত করে। এই ৮৭৯ জন এর মধ্যে ৪৯০ জন নারী চিকিৎসক। যার মধ্যে চলতি বছরের ১৭ জুলাইয়ের প্রজ্ঞাপনে ১৩ বিষয়ে ২১৮ জন; ২৯ জুলাইয়ের প্রজ্ঞাপনে ২৫ বিষয়ে ২১৭ জন; ১ সেপ্টেম্বরের প্রজ্ঞাপনে ৯ বিষয়ে ১৬৩ জন; ২ সেপ্টেম্বরের প্রজ্ঞাপনে ২৪ বিষয়ে ৫৬ জন; ২৩ অক্টোবরের প্রজ্ঞাপনে এক বিষয়ে ২৮৫ জনকে (সবাই নারী চিকিৎসক) কোনো ধরনের চাকরিবিধি, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, তারা নিয়মমাফিক পদোন্নতি প্রদানের জন্য সব প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রতিটি পদোন্নতির আদেশ হওয়ার আগে ছয় সদস্যের একটি চিকিৎসক প্রতিনিধি মন্ত্রণালয়ে ঢুকে তালিকায় হস্তক্ষেপ করেন। তারা যাদের জন্য সুপারিশ করেন তাদের পদোন্নতি হয়, যাদের বাদ দিতে বলেন তারা বাদ পড়েন। এই ছয়জন চিকিৎসকের মধ্যে দুজন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম (এনডিএফ), দুজন ড্যাব এবং দুজন এনসিপি মনোনীত। মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের সম্মতিতেই এসব হচ্ছে।
২০২৩ সালের ৮ মে যারা সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদনোন্নতি পেয়েছেন, মাত্র দুই বছর পাঁচ মাস পর তাদের সহযোগী অধ্যাপক করা হয়। কোন বিধিবলে তারা পদোন্নতি পেয়েছেন, তার ব্যাখ্যা মন্ত্রণালয় দিচ্ছে না। বিধি অনুযায়ী ফিডার পদে তিন বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলেই সহযোগী অধ্যাপক হতে পারেন। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন এখন মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সুপার নিউমারারি পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিল, সেসব শর্তও মানা হচ্ছে না।
পদোন্নতিবঞ্চিত অর্ধশত চিকিৎসক কালবেলাকে জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি দিয়েই যাচ্ছে। বঞ্চিতদের সংখ্যা ক্রমশ ভারী হচ্ছে। একদিকে সব শর্ত পূরণ করেও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না, অন্যদিকে বিশেষ কাউকে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বারবার বিধি ভাঙা হচ্ছে।
অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কোনো গ্রেডেশন লিস্ট করা হয়নি। তাই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, বোঝা কঠিন। মন্ত্রণালয় খেয়াল-খুশি মতো পদোন্নতি দিয়ে যাচ্ছে। কোথাও ঝামেলা হতে পারে মনে করলে আদেশে ‘প্রমার্জনা পূর্বক’ শব্দটা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। শুধু গাইনির দুটি আদেশ ঘেঁটে দুই বার প্রমার্জনা পেয়েছেন, এমন সাতজন পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, বাদ পড়াদের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর কালবেলাকে বলেন, পদোন্নতির তালিকা থেকে যারা বাদ পড়েছেন তাদের কারও কোনো ঘাটতি আছে কি না, সেটা দেখতে মন্ত্রণালয় থেকে রিভিউ আবেদন করতে বলা হয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বঞ্চিতরা মন্ত্রণালয়ে রিভিউ আবেদন করেছেন। মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে এ বিষয়গুলো রিভিউ হবে। তবে এখনো রিভিউ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
মন্তব্য করুন