করোনার সময়ে রাজধানীতে খাদ্যপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে পার্সেল ও কৃষি ট্রেন চালু করে রেলওয়ে। যদিও এতে সে সময় কৃষকদের কাছ থেকে তেমন একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। সময় ও ব্যয় বিবেচনায় কৃষকরা সড়কপথে পণ্য সরবরাহে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এ কারণে রেলওয়ের ওই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কোনোরকম সমীক্ষা ছাড়াই ফের দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষিপণ্য পরিবহনে ৩৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনেছে রেলওয়ে। এগুলো সংযুক্ত করা হচ্ছে বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেনে। গতকাল রোববার এ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। প্রথম দিন কমলাপুর থেকে চারটি ট্রেনে পণ্য পরিবহন করা হয়।
এদিকে রেলের বাণিজ্যিক বিভাগের লোকজনসহ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল পরিকল্পনার কারণে প্রকল্পটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। লাগেজ ভ্যান কেনাকাটার পুরো অর্থই গচ্চা যেতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এ ব্যাপারে ঢাকা ও জেলা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় বৈঠক করেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান পণ্য পরিবহনে যুক্ত সেগুলোকেও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। মাঠ থেকে রেলস্টেশনে কীভাবে পণ্য সরবরাহ করা হবে বা গন্তব্যে পৌঁছানোর পর সেগুলো কীভাবে আড়তে যাবে এ ব্যাপারে নেই কোনো নির্দেশনা। পরিকল্পনা ও সমীক্ষা ছাড়া ডেমু ট্রেনের মতো এ খাতের পুরো বিনিয়োগও কাজে না লাগার আশঙ্কা আছে।
জানা গেছে, আয় বাড়াতে মালবাহী বগি পরিচালনার পুরোনো চিন্তা থেকে লাগেজ ভ্যান আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধাসহ সময় ও পণ্য আমদানি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়নি। এ নিয়ে সমালোচনা শুরুর পর টনক নড়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। গত সপ্তাহে রেল কর্তৃপক্ষ সব বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তাদের পণ্য পরিবহনে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায় এমন পদক্ষেপ গ্রহণের মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছে। রেলওয়ে বলছে, প্রকল্পটি সফল করার বিষয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করছে। তবে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরাও জানান, পণ্য আমদানির বিষয়ে এখনো তাদের সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের কোনো আলোচনা হয়নি।
এদিকে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন কালবেলাকে বলেন, মানুষের সুবিধার্থে আমরা বিভিন্ন আন্তঃনগর ট্রেনের সঙ্গে লাগেজ ভ্যান যুক্ত করছি। মানুষ তার প্রয়োজনেই অল্প ব্যয়ে পণ্য আমদানিতে উৎসাহিত হবে। তা ছাড়া প্রতিটি প্রকল্প গ্রহণের সময় সমীক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমাদের লক্ষ্য প্রান্তিক কৃষকদের সব পণ্য রেলে পরিবহনের জন্য ডাইভার্ট করে নিয়ে আসা। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, সুবিধা নিশ্চিত হলে মানুষ এমনিতেই আমাদের কাছে আসবে।
প্রসঙ্গত, রেলের আয়ের অন্যতম খাত হলো পণ্য পরিবহন। আর এটি করা হয় লাগেজ ভ্যানের মাধ্যমে। বর্তমানে রেলওয়েতে ৪১টি মিটারগেজ ও ১০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান আছে। এগুলোর বেশিরভাগের আয়ু শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই পণ্য পরিবহন থেকে যথেষ্ট আয় করতে পারছে না রেলওয়ে। এমন পরিস্থিতিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ‘রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় নতুন করে অত্যাধুনিক ৭৫টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান সংযোজনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ব্রডগেজে ১০টি রেফ্রিজারেটর আর মিটারগেজে ১৬টি রেফ্রিজারেটর থাকবে। এতে খুলনা বা কক্সবাজার থেকে হিমায়িত মাছ, দুধ, মাংস ও অন্যান্য পণ্য আনা যাবে।
সরকার ২০১৮ সালের ২৬ জুন পণ্য পরিবহন ও যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে আধুনিক, নিরাপদ এবং গুণগত মানসম্মত রোলিং বহরে স্টক যুক্ত করার লক্ষ্যে ৩ হাজার ৬০২ কোটি ৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের রোলিং স্টক অপারেশন উন্নয়ন প্রকল্পের (রোলিং স্টক সংগ্রহ) অনুমোদন দেয়। এই প্রকল্পে এডিবি ২ হাজার ৮৩৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত হলেও পরে তা বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। সে অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট বাংলাদেশ রেলওয়ে ও চীনের মধ্যে লাগেজ ভ্যান সংগ্রহে দুটি চুক্তি সই হয়। ২০২২ সালের জুলাই থেকে এসব লাগেজ ভ্যান বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা ছিল।
প্রথম লটে আসা লাগেজ ভ্যানগুলোকে ২০টি বিভিন্ন ট্রেনে পরিচালনার প্রস্তাব করেছে রেলওয়ের পূর্ব কার্যালয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর এই কার্যালয়ের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট মো. শহিদুল ইসলাম এ ব্যাপারে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী বরাবর আনুষ্ঠানিক চিঠি দেন। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি লাগেজ ভ্যানগুলো দেশে পৌঁছানোর কথা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাড়তি ব্যয় ও ঢাকার বাজারের সঙ্গে ট্রেনের সিডিউলের মিল না থাকায় লাগেজ ভ্যানে পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হবেন না কৃষকরা। কারওয়ান বাজারের একাধিক মাছ ও অন্যান্য ব্যবসায়ী কালবেলাকে বলেন, ট্রেনে পণ্য সরবরাহ করা কঠিন। প্রতিটি স্টেশন থেকে পণ্যের হাটের দূরত্ব অনেক। ঢাকায় আসার পর বাজারে আনতে আবারও বিকল্প ট্রাকের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে ব্যয় বাড়বে। একই কথা বলেন রেলওয়ের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন স্টেশন মাস্টারসহ রেল কর্মকর্তারাও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত জেলাগুলোর কৃষি বাজার বিশ্লেষণ না করেই লাগেজ ভ্যান কেনা হয়েছে। তাই এ প্রকল্পের পরিণতি ডেমু ট্রেনের মতোই রেলওয়ের গলার কাঁটায় রূপ নিতে পারে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান বলেন, অপারেটিং কস্টের কারণে হিমায়িত পণ্য বাড়ি বাড়ি সার্ভিস দেওয়া সম্ভব নয়। তাই পরিকল্পনা ও সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প করা হলে তা কখনোই সফল হতে পারে না।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী বলেন, রেলে পণ্য পরিবহন নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকে এ ব্যবস্থা প্রচলিত। আগে রেলে ও ডাক বিভাগের মাধ্যমে মানুষ পণ্য পাঠাত। আমাদের মূল লক্ষ্য কৃষকদের পাশে থাকা। তারা যেন পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাগেজ ভ্যান সরবরাহ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা অনেক আগেই অবসরে গেছেন। তাই এ ব্যাপারে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী বলেন, পণ্য পরিবহনে ডোর টু ডোর সার্ভিস যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ আছে। কীভাবে এটা করা যায়, তাই ভাবছি। অল্প দিনের মধ্যেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগি দেশে এসে পৌঁছাবে।
মন্তব্য করুন