রীতা ভৌমিক
প্রকাশ : ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ০৫:১৭ এএম
আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ১১:১০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক’ তিন বছর ধরে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়

পড়ে আছে দেড় কোটি টাকার যন্ত্র
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা বা ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতার কারণে রাজধানীর মাতুয়াইলের মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে তিন বছর ধরে পড়ে আছে দেড় কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। জন্মের সময়ে মা হারা কিংবা অন্য কোনো কারণে মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত নবজাতকদের মাতৃদুগ্ধ সরবরাহের লক্ষ্যে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশুর জন্য নিজ মায়ের দুধ সংরক্ষণও ছিল আরেকটি উদ্দেশ্য। বিষয়টি ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর বিবেচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতামত চাওয়া হয়। দীর্ঘদিনেও সুনির্দিষ্ট জবাব না পাওয়ায় থমকে আছে উদ্যোগটি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মায়ের দুধের অভাবে দেশে প্রতিবছর অনেক শিশু মারা যায়। আবার জন্মের পর চাহিদা অনুযায়ী মায়ের দুধ না পাওয়ায় অনেক শিশু অপুষ্টি নিয়ে বেড়ে ওঠে। জন্মের সময় মায়ের মৃত্যুর কারণে অনেক শিশু মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হয়। আবার মায়ের অসুস্থতা বা শারীরিক সমস্যার কারণে অনেক শিশু সঠিক মাত্রায় দুধ পায় না। এই শিশুদের জন্য মাতৃদুগ্ধ

সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই দেশে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ বা মাতৃদুগ্ধ সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাশাপাশি এনআইসিওতে চিকিৎসাধীন শিশুর নিজ মায়ের দুধ সংরক্ষণ করাও এই ব্যাংকের উদ্দেশ্য।

অন্যদিকে প্রতিবছর দেশে অনেক নবজাতককে পরিত্যক্ত অবস্থায় কুড়িয়ে পাওয়া যায়। এই শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতেও মাতৃদুগ্ধ জরুরি হয়ে পড়ে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে এ শিশুদের তাৎক্ষণিকভাবে মায়ের দুধ সরবরাহ সম্ভব হবে।

জানা গেছে, কয়েক মাস আগে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া এক নবজাতককে মাতুয়াইল মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে এনে প্রতিপালন করা হয়। মায়ের দুধ ছাড়া এই শিশুকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না। এরকম অনেক শিশু মায়ের দুধ পান করে বেঁচে আছে।

জানা গেছে, হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় অর্থায়ন করেন মাতুয়াইল মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মজিবুর রহমান এবং পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও তিনজন মুসলিম দাতা। দেড় কোটি টাকায় পাস্তুরাইজিং মেশিন, অত্যাধুনিক ফ্রিজসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আনা হয়। যন্ত্রপাতিগুলোর নকশা করা হয় স্পেনে। সেই নকশা অনুযায়ী ভারতের মুম্বাই থেকে এগুলো তৈরি করে আনা হয়। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে যন্ত্রপাতিগুলো স্থাপন এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০২১ সালে এটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও দুবার আবেদন করেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত অনুমতি মিলেনি। অথচ পরে উদ্যোগ নিয়েও একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ২০২২ সালের অক্টোবরে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের’ কার্যক্রম চালু করেছে মালয়েশিয়া। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েত ও দুবাইতেও এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে।

জানা গেছে, মাতুয়াইল শিশু মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ স্থাপনের বিষয়ে মতামত চেয়ে ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘এসসিএএনইউ এবং এনআইসিইউতে অপরিণত, গুরুতর অসুস্থ নবজাতক, যারা মাতৃদুগ্ধ ছাড়া মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে সে সব শিশুর মৃত্যুরোধে বিনামূল্যে মাতৃদুগ্ধ সরবরাহে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

এতে আরও বলা হয়, ‘সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা সংরক্ষণ করে একজন মায়ের বুকের দুধ একজন শিশুকেই পান করানো হবে। ভবিষ্যৎ বৈবাহিক সম্পর্ক নিরাপদ রাখার স্বার্থে দুধমাতা ও দুধ গ্রহণকারী শিশুর দ্বিপক্ষীয় পরিচিতি এবং সম্পর্ক পুরোপুরি সংরক্ষণ করা হবে।’

তবে দুই বছরেও এই চিঠির জবাব না আসায় ২০২২ সালের ১ এপ্রিল ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে আরেকটি চিঠি দেয় বেসরকারি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল (এফএইচআই ৩৬০)।

মাতুয়াইল মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক ডা. মো. মজিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশের আলেম সমাজকে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কী উদ্দেশ্যে, কী কারণে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে—তা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। তারা বিষয় গুরুত্ব সহকারে শুনেছেন। এটি চালু করতে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং সমাজসেবা অধিদপ্তর—এই চার প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে এক মায়ের দুধ একজন শিশুকেই দেওয়া হবে। আবার এক শিশুকে একাধিক মায়ের দুধও দেওয়া হবে না। একজন মায়ের বুকের দুধ একটি কনটেইনারে সংরক্ষণ করা হবে। সেই কনটেইনারে যে মায়ের দুধ ছিল এবং যে শিশু ওই দুধ পান করেছে, তা সঠিকভাবে রেকর্ড রাখা হবে। প্রতিটি শিশুর নিজের বাবা-মায়ের নাম-পরিচয়, দুধ মায়ের নাম-পরিচয় থাকবে। এ ছাড়া মায়ের নামের পাশাপাশি এনআইডিতে দুধ মায়ের নাম লিখে দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হবে।’

এ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মোহাদ্দিস ড. অলিউর রহমান খান কালবেলাকে বলেন, ‘এটা কোনো ব্যক্তিগত ফতোয়া নয়, এটা জাতীয় ইস্যু। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলে বিশিষ্ট আলেম ও শরিয়াহ, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। সরকারিভাবে এই কমিটি গঠন হওয়ায় এর আইনি ভিত্তি তৈরি হয়। এই কমিটির সদস্যরা বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে মতামত দেন।’

হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে কাগজপত্র দিয়েছিল। সেই কাগজপত্রসহ নির্বাচিত মুফতিদের সামনে যখন উপস্থাপন করা হলো তারা বললেন, কুয়েত, দুবাই, মালয়েশিয়াতে যেভাবে হয়েছে সে রকম ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে হবে কি না—তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একজন মায়ের দুধ যে রাখা হলো, যত শিশু সেটা পান করবে, তারা সবাই সেই মায়ের সন্তান হয়ে যাবে। এই মায়ের স্বামীর ছেলেমেয়ে হয়ে যাবে। তাদের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে পারস্পরিক বিয়ে তাদের জন্য হারাম হয়ে যাবে। ধর্মীয় এই নীতি-বন্ধন কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?’

ড. অলিউর রহমান খান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে বড় বড় ভুল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই ২০২০ সালের পর আর এ নিয়ে মিটিং করা হয়নি। নতুন করে আবেদন পেলে শরিয়াহ বোর্ডের আলেমদের ডেকে আবারও প্রেজেনটেশন দেওয়া। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের সংবেদনশীল ইস্যুতে আমরা কী করতে পারব জানি না।’

অবশ্য মাতুয়াইল শিশু মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের খসড়া নীতিমালায় সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক (মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক) ইসলামী শরিয়াহ রীতিনীতি এবং আল কোরআনের সূরা নিসার ২৩ নম্বর আয়াতের বিধিবিধান অনুসরণ করে একটি কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হবে। প্রত্যেক মায়ের বুকের দুধ আলাদা আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হবে। একজন মায়ের বুকের দুধ শুধু একজন নবজাতককে খাওয়ানো হবে।’

জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মো. বশিরুল আলম বলেন, ‘এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য আমার জানা নেই। গবেষণা বিভাগকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুফতি-আলেমদের পরামর্শ অনুযায়ী কোনো মতামত দেওয়া হয়েছিল কি না, আমি অবগত নই।’

ফাউন্ডেশনের পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাসুদের মতে, ‘বিভিন্ন কারণে অনেকে দ্বিমত পোষণ করায় এই উদ্যোগের পক্ষে ইতিবাচক মতামত দেওয়া যায়নি। যদিও এটি একটি ভালো উদ্যোগ। দুবাই, কুয়েত, মালয়েশিয়ায় হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক রয়েছে।’

সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক টিটো মিঞা কালবেলাকে বলেন, ‘এটি একটি ভালো উদ্যোগ। অনেক দেশেই এটি চালু রয়েছে। আমাদের দেশের সামাজিক পটভূমির কারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এটাকে ফের চালু করতে হলে উদ্দীপনামূলক আলোচনা দরকার। বিষয়টি নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে আবার আলোচনায় বসব। তাদের এর বিজ্ঞানভিত্তিক, শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ইত্যাদি বিষয়গুলো বোঝালে আমরা নিশ্চিত ইতিবাচক ফলাফল পাব।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কৃষিবিদ আসাদুজ্জামান কিটোনকে সংবর্ধনা দিল এ্যাব

মাছ ধরার নৌকায় মিলল সাড়ে ৪ লাখ পিস ইয়াবা, আটক ৯

ভোলায় নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল / এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

যৌথবাহিনীর অভিযানে অনলাইন জুয়া চক্রের ২ সদস্য আটক

জেলেরা হেলমেট পরে মাছ ধরেন যেখানে

বিমানবাহিনীর আন্তঃঘাঁটি স্কোয়াশ প্রতিযোগিতা সমাপ্ত

স্পেনে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

কারাগারে সন্তান জন্ম দিলেন হত্যা মামলার আসামি

সিলেটের সাদাপাথর লুটের ঘটনায় সিআইডির অনুসন্ধান শুরু

হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সম্মেলন ৬ সেপ্টেম্বর

১০

ডাকসুর ভিপি প্রার্থী জালালের বিরুদ্ধে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ

১১

ডাকসু নির্বাচন / ছাত্রলীগ সম্পৃক্ততার দায়ে বাদ জুলিয়াস সিজার

১২

ধর্ষণসহ হত্যায় ফুফাতো ভাইয়ের যাবজ্জীবন

১৩

কাজী নজরুলের কবিতা দেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস যুগিয়েছে : তারেক রহমান

১৪

‘রোহিতকে সরানোর জন্যই ব্রঙ্কো টেস্ট এনেছে বিসিসিআই’

১৫

অভিনেত্রী হিমুর আত্মহত্যা, প্রেমিক রাফির বিচার শুরু

১৬

ভারতে প্রয়াত ক্রিকেটারদের স্ত্রীরা পাবে অনুদান

১৭

রাজধানীতে একক ব্যবস্থায় বাস চলবে : প্রেস উইং

১৮

ভিনিকে বিক্রি করে দিতে বললেন রিয়াল কিংবদন্তি

১৯

নতুন বিচারপতিদের মধ্যে সংখ্যালঘু নেই, ঐক্য পরিষদের ক্ষোভ

২০
X