সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য আকাশছোঁয়া ব্যয় প্রস্তাব করেছিল সংস্থাটি। উন্নয়নের জন্য অস্বাভাবিক ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বিভিন্ন মহলে। অবশেষে একনেকে সেই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত ব্যয় থেকে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি কমিয়ে দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এতে বন্ধ হলো বিপুল অঙ্কের টাকা অপচয়ের সুযোগ।
জানা গেছে, মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে টেকসই যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (১) শীর্ষক প্রকল্প প্রস্তাব করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। এ জন্য ব্যয় ধরা হয় ১২ হাজার ১৩৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ৮ হাজার ৮৭২ কোটি ৩৬ লাখ এবং সরকার দেবে ৩ হাজার ২৬৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাব করায় আপত্তি তোলে পরিকল্পনা কমিশন। যাচাই-বাছাই শেষে প্রস্তাবের চেয়ে ৩ হাজার ৫৮০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা কমিয়ে অনুমোদন দেয় কমিশন। এর মধ্যে জাইকার ঋণ থেকে ৩ হাজার ১৬৩ কোটি ২৪ লাখ এবং সরকারি তহবিল থেকে ৪১৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা কমানো হয়। ফলে এখন প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ব্যয় কমানোর ফলে সরকারের বাঁচল ৪১৭ কোটি এবং জাপান থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ কমলো ৩ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, একই ধরনের চলমান অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে এই প্রকল্পে অনেক বেশি ব্যয় ধরা হয়েছিল। সেজন্য নানাভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়। কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের কর্মকর্তারা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। এর আগে কখনো এক প্রকল্প থেকে এত বিপুল অঙ্কের টাকা কমানো হয়নি।
কমিশনের কর্মকর্তারা দৈনিক কালবেলাকে জানান, প্রকল্পটিতে কিছু অপ্রয়োজনীয় খাত রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল। যে পরিমাণ অর্থ কমানো হয়েছে, তাতে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে না। আমরা কোনো খাত বাদ দেইনি।
এ বিষয়ে কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান দৈনিক কালবেলাকে বলেন, প্রথম যখন এই প্রকল্পের প্রস্তাব আসে তখন পিইসি সভায় পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি। পরে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে চলমান ৪টি প্রকল্পের ব্যয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে এতে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। সবদিক বিবেচনা ও তিন দফা মিটিং করে ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেসব খাতে অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেগুলো মাইনাস করা হয়েছে। এক প্রকল্প থেকেই সরকারের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বেঁচে গেল।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন দৈনিক কালবেলাকে বলেন, পরিকল্পনা কমিশন ব্যয় কমিয়ে ঠিকই করেছে। কারণ এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, সেটা অবশ্যই বেশি ছিল। ব্যয় কমিয়ে সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা বাঁচিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এখানে মূল্য ব্যয়ের চেয়ে প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট খাত অনেক বেশি ধরা হয়েছিল। এ ছাড়া পরামর্শক খাতে ৪শ কোটির বেশি চাওয়াটা অনেক বেশি ছিল। এ ধরনের প্রকল্পে এত বেশি টাকা লাগে না। শুরুতেই যদি গলদ থেকে যায়, তাহলে অপচয়ের সুযোগ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে সেটা বন্ধ হলো।
জানা গেছে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে চার লেনে উন্নয়নের জন্য প্রতি কিলোমিটার ২৫৬ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করে। এ হিসাব একই ধরনের চলমান অন্যান্য প্রকল্পের বরাদ্দের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। ২৩ দশমিক ৫২ কিলোমিটার মহাসড়ককে শুধু চার লেন করার জন্যই এ ব্যয় ধরা হয়। এতে ফ্লাইওভার, সেতু নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণসহ সম্ভাব্য অন্যান্য ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব খাতের খরচ যোগ করলে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা।
গত সপ্তাহে প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভায় ১২ হাজার ১৩৬.৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি তোলে কমিশন। এর আগে একই সংস্থা মহাসড়ককে চার লেন করার জন্য ভাঙ্গা-যশোর-বেনাপোল প্রকল্পে কিলোমিটার প্রতি ৮৫.৭৯ কোটি টাকা, ঢাকা-সিলেট প্রকল্পে কিলোমিটার প্রতি ৮২ কোটি টাকা ও এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর প্রকল্পে কিলোমিটার প্রতি ৯৪.৩১ কোটি টাকা ব্যয় প্রস্তাব করে। তাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রকল্পে ব্যয় এত বেশি হওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে কমিশন প্রশ্ন তোলে।
আলোচ্য প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি ব্যয় কমানো হয়েছে প্রাইস এডজাস্টমেন্ট খাতে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। যেটাকে অত্যধিক উল্লেখ করে ২ হাজার ৩৮ কোটি টাকা ২৮ লাখ টাকা কমিয়ে দিয়েছে কমিশন। এ খাতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৬২৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ফ্লাইওভার ও সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ২৮১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ খাত থেকে কমানো হয়েছে ৯৬৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া পরামর্শক খাতে ৪৯৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকার স্থলে ১৯৫ কোটি টাকা কমিয়ে ২৯৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কমিশনের কর্মকর্তারা বলেন, এই প্রকল্পের তুলনায় কারিগরি দিক থেকে অনেক বেশি জটিল কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরামর্শক ব্যয় ধরা হয় ৩০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এটা অনেক বেশি ছিল।
এ ছাড়া রোড সেফটি ফ্যাসিলিটিজ খাতে ৯ কোটি, নিরাপত্তা খাতে ৭২ কোটি, ইউটিলিটি খাতে ৫৫ কোটি, সফট সয়েল ট্রিটমেন্ট খাতে ৪ কোটি, প্রটেকশন ওয়ার্কস খাতে ৫ কোটি, ড্রেইনেজ খাতে ৯১ কোটি, পেভমেন্ট খাতে ৬৩ কোটি, মাটির কাজে ৬ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। এর বাইরেও বিভিন্ন খাতেও ব্যয় কমানো হয়েছে।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর জানিয়েছে, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের মধ্যে প্রস্তাবিত অংশটি এখনো দুই লেনের সড়ক। একাধিক স্থানে বাঁক ও বড় বাজার রয়েছে। ফলে বিশাল যানজট তৈরি হয়। সড়কের এ অংশে দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। এসব বিবেচনা এবং কক্সবাজারের নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে টেকসই যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে এই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় পটিয়া, দোহাজারী, লোহাগড়া, চকরিয়ায় চার লেনের আউটার রোড নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া কেরানীহাটে নির্মাণ করা হবে ফ্লাইওভার। মহাসড়ক উন্নয়নের ব্যয় এত বেশি ধরার কারণ হিসেবে অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে। ওই সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়। এতে জাপানের মানদণ্ড অনুযায়ী ব্যয় ধরা হয়েছিল।