দুই যুগেরও বেশি সময়ে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের শতাধিক মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এক প্রবাসী বাংলাদেশি। দুই দেশেই তার নামে আছে মানব পাচার ও প্রতারণার একাধিক মামলা। নানা কৌশলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক জাল পাসপোর্ট তৈরি করে নিয়েছেন এই প্রতারক। বদলে ফেলেছেন মা-বাবার নামও। দু-দুবার র্যাবের হাতে ধরা পড়লেও নতুন নামে পাসপোর্ট বানিয়ে ফের পালিয়েছেন মালয়েশিয়ায়।
সবার চোখ ফাঁকি দেওয়া এই বহুমুখী জালিয়াতের প্রকৃত নাম আব্দুল গণি। তবে পাসপোর্টসহ বিভিন্ন কাগজপত্রে তরিকুল ইসলাম, আল আমিন, ডালিম কিংবা ওসমান গণি নাম ব্যবহার করেছেন তিনি। বহুরূপী এই ব্যক্তির গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার গোয়ালদী চর এলাকায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জীবিকার তাগিদে নব্বইয়ের দশকে গলাকাটা পাসপোর্ট নিয়ে মালয়েশিয়ায় যান আব্দুল গণি। সেখানে জড়িয়ে পড়েন অপরাধজগতের সঙ্গে। একের পর এক অভিযোগ উঠতে থাকায় পাসপোর্ট কালো তালিকাভুক্ত করে তাকে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেয় দেশটির পুলিশ। দেশে ফিরে তরিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির পাসপোর্টে নিজের ছবি লাগিয়ে ফের যান মালয়েশিয়ায়। আব্দুল গণি থেকে হয়ে যান তরিকুল ইসলাম। বদলে যায় মা-বাবার নামও। মালয়েশিয়ায় স্থায়ী বসবাসের অনুমোদন বাগিয়ে নেন। নতুন পরিচয়ে আবারও জড়িয়ে পড়েন অপরাধজগতে। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আব্দুল গণি। কাজের অনুমতি (ওয়ার্ক পারমিট) পাইয়ে দেওয়া কথা বলে শত শত বাংলাদেশি শ্রমিকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। এমনকি অনেক বাংলাদেশিকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নতুন নতুন মামলায় জড়িয়ে একপর্যায়ে বাধ্য হন মালয়েশিয়া ছাড়তে।
দেশে ফিরেই শুরু করেন প্রতারণা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আব্দুল গণিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১, যা তদন্তে জাল-জালিয়াতির প্রমাণ পেয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করে র্যাব (নং-২০, তারিখ ১১-০২-২০২২)। এরপর মানব পাচার ও প্রবাসীদের জিম্মি করে টাকা আদায় চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে করা আর একটি মামলায় আব্দুল গণিকে চলতি বছরের ২৩ মে ফের গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১।
জানতে চাইলে র্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা আব্দুল গণিকে ২০২২ সালে প্রথমে আটক করি। এরপর তার পাসপোর্টে অন্য নাম দেখে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে তদন্ত করি। একপর্যায়ে আব্দুল গণি তার পরিচয় জালিয়াতির কথা স্বীকার করলে তার বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করি। কিন্তু মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমাদের না জানিয়ে আদালতে ভুল প্রতিবেদন দেয়। বিষয়টি জানতে পেরে আমরা আদালতে নারাজি দিলে মামলা পুনরায় তদন্ত করতে নির্দেশ দেন আদালত।’
তিনি বলেন, ‘চলতি বছর মে মাসে বরিশালের গৌরনদী থানায় করা একটি মানব পাচার মামলায় ফের তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পেশ করা হয়। পরে শুনেছি তিনি জামিনে বের হয়ে ফের দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের ১২ এপ্রিল গৌরনদী থানায় মানব পাচার আইনে আব্দুল গণির বিরুদ্ধে একটি মামলা (নং-৯, তারিখ ১২-০৪-২৩) করা হয়। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো. কামাল হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘তদন্তে বাদীর অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছি এবং আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।’
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, আসামি আব্দুল গণি একটি সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারী দলের সক্রিয় সদস্য। আব্দুল গণি ও তার চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার অসহায় এবং সহজ-সরল লোকদের টার্গেট করে ফুসলিয়ে তাদের মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করে তাদের দাসত্বমূলক শ্রমে বাধ্য করে।
মালয়েশিয়ায় আব্দুল গণির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এক সময় ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন আফজাল হোসেন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘নিজের চোখে দেখেছি, তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অনেক প্রবাসীকে টানা ৫-৬ মাস বেতন দেওয়া হয়নি। বেতন চাইলে মারধর করে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। একপর্যায়ে আমারও সাত মাসের বেতন আটকে যায়। গণির ব্যবসায়িক পার্টনার ছিল জোহুর বারুর পুলিশ কমিশনার। আমি বিষয়টি তার পার্টনারকে জানালে আব্দুল গণি আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। পরে আমি ওখানকার ওসিকে ম্যানেজ করে কমিশনারকে ফোন করলে তিনি আমাকে ছাড়িয়ে নেন। পরে আমার কাছ থেকে বিস্তারিত জানার পর ওই কমিশনার তার সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে দেন।’
এই ভুক্তভোগী আরও বলেন, আব্দুল গনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশিদের পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে আবার কমিশনারকে দিয়ে ছাড়াত। বিনিময়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ হাজার রিংগিত বা বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ২০ হাজার করে টাকা নিত। কেউ টাকা দিতে না পারলে নিজের কক্ষে আটকে রেখে নির্যাতন করত। আমি এ নিয়ে কথা বলায় আব্দুল গনি গ্যাংস্টার দিয়ে হামলা চালিয়ে আমাকে কুপিয়ে রেখে চলে যায়।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় অবস্থানকালে আব্দুল গনি সে দেশের এক নারীকে বিয়ে করেন। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কল্যাণ সহকারী মোকসেদ আলীর সঙ্গে তার গভীর সখ্য। মোকসেদ আলী তাকে বিভিন্ন জায়গায় ভাই হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের মালয়েশিয়া শাখার সহসভাপতির সঙ্গে তার গভীর সখ্য রয়েছে। এদের জোরেই দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ভয়ংকর প্রতারক আব্দুল গণি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, জামিনে বের হয়ে প্রথম দফায় দেশ ছেড়ে পালাতে গেলে গণিকে আটক করে শাহজালাল বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশ। পরে তাকে গৌরনদী থানা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর জামিনে বের হয়ে তিনি অবলম্বন করেন ভিন্ন পন্থা। এবার আব্দুল গণি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমান মাসুমের স্বাক্ষর জাল করে নানা যোগসাজশে জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করেন। সেটি ব্যবহার করে নতুন পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ছাড়েন। নতুন পাসপোর্টে তার নাম ওসমান গণি ওরফে তরিকুল ইসলাম। এতে জীবিত পিতাকে মৃত দেখানো হয়েছে। পিতার নাম লেখা হয়েছে আশেক আলী ওরফে মো. আবদুল জলিল। আর মায়ের নাম শরিফুন নেছা ওরফে শানু বেগম। বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউপি চেয়ারম্যান সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি চিঠি দিয়েছেন।
জানা গেছে, নাম পরিবর্তন করে নতুন পাসপোর্ট নিয়ে মালয়েশিয়া গিয়ে এবার বিপাকে পড়েছেন আব্দুল গণি। তার মালয়েশিয়ায় স্থায়ী বসবাসের অনুমোদনের সঙ্গে পাসপোর্টের নাম না মেলায় সম্প্রতি মোকসেদ আলী এবং ওই রাজনৈতিক নেতা দূতাবাসে পাসপোর্ট সত্যায়িত করার চেষ্টা করলে দূতাবাস সেটি নাকচ করে দেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় আব্দুল গণির বিরুদ্ধে প্রতারণা, মানবপাচারসহ একাধিক অভিযোগে মামলা রয়েছে। দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগের তদন্তে বেড়িয়ে এসেছে জাল কাগজ ও ভুয়া নাম-পরিচয় এবং প্রবাসীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতারণার বিষয়টি। প্রতারক গণি প্রবাসীদের ওয়ার্ক পারমিট, ভিসা, পাসপোর্ট করে দেওয়ার নামে হাজার হাজার মালয়েশিয়ান রিংগিত হাতিয়ে নিয়েছেন। মালয়েশিয়ান পুলিশের দায়ের করা একাধিক মামলা ও তদন্ত প্রতিবেদন রয়েছে কালবেলার হাতে। এ ছাড়া তার একাধিক পাসপোর্ট রয়েছে— যার নম্বর ইএইচ-০৭০৫৫৮০ ও বিএফ-০০৮৫২২৫। এই পাসপোর্ট ব্যবহার করে পাওয়া মালয়েশিয়ায় স্থায়ী বসবাসের পারমিট নম্বর ৭৭০৮১১-৭৯৫০১৩।
এসব বিষয়ে জানতে আব্দুল গণির সঙ্গে কালবেলার মালয়েশিয়া প্রতিনিধির মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। বেশ কয়েকদিন ধরে একাধিক নম্বর থেকে তাকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর বক্তব্য জানতে চেয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হলে তিনি এই প্রতিবেদকের নম্বর ব্লক করে দেন।