জাফর ইকবাল
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৫১ এএম
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পল্লবী-রূপনগরে বেপরোয়া ১০ মাদক কারবারি

অপরাধের স্বর্গরাজ্য
পল্লবী-রূপনগরে বেপরোয়া ১০ মাদক কারবারি

রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুই থানা পল্লবী ও রূপনগর। এ এলাকায় রয়েছে কয়েকটি বিহারি ক্যাম্প। এসব ক্যাম্পে প্রায় অর্ধলাখ অবাঙালির বাস। আর পল্লবী ও রূপনগরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ২১ হাজার লোকের বাস। জনসংখ্যার চাপ এখানে খানিকটা বেশি। আর এই ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যেই রূপনগর ও পল্লবী এলাকা হয়ে উঠেছে মাদক ও অপরাধের স্বর্গরাজ্য। এখানকার অলিগলিতে প্রকাশ্যেই চলে ইয়াবা-হেরোইনের মতো ভয়ংকর মাদক বিকিকিনি। একেকটি বিহারি ক্যাম্প হয়ে উঠেছে মাদকের ‘ডেরা’। ক্যাম্পকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা ১০ শীর্ষ মাদক কারবারি পাড়া-মহল্লাভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে বিক্রয় এজেন্ট। পুলিশের চোখের সামনে মাদকের এমন রমরমা বাণিজ্য চললেও ক্ষেত্রবিশেষ নিষ্ক্রিয় থাকে পুলিশ। এ ছাড়া পুলিশের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততার অভিযোগও।

২০১৪ সালের ১৩ জুন বিহারি ক্যাম্পে একই পরিবারের ৯ জনকে আগুনে পুড়িয়ে মারাসহ খুন হয় ১০ জন। এখনো এ মামলার কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর পরও বিভিন্ন সময়ে কয়েকবার খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। আহত-নিহত হয়েছে কয়েক ডজন মানুষ। এর বেশিরভাগ খুনোখুনির নেপথ্যেই ছিল মাদক কারবার। প্রকাশ্যে মাদক বিকিকিনির অন্তত দেড় ডজন ভিডিও রয়েছে কালবেলার হাতে। এসব ভিডিওতে মদ, ইয়াবা, গাঁজা ও হেরোইনের মতো ভয়ংকর সব মাদক বিক্রি করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া কয়েকটি ভিডিওতে বাসায় বসে ইয়াবা গণনা করতেও দেখা গেছে কারবারিদের। ক্যাম্প থেকে সহজেই যে কেউ মাদক ক্রয় করতে পারছে। অতিরিক্ত কিছু টাকা দিলে ক্যাম্পে মদ, গাঁজা কিংবা ইয়াবা সেবনেরও ব্যবস্থা আছে।

সরেজমিন দেখা যায়, মাদকের ডেরায় পরিণত হয়েছে মিল্লাত ক্যাম্প, এডিসি ক্যাম্প, রহমত ক্যাম্প, মুসলিম ক্যাম্প, থার্টিনাস ক্যাম্প, কুর্মিটোলা ক্যাম্প, এমসিসি ক্যাম্প, শাহপরাণ ক্যাম্প, শাহপরাণ বস্তি, কেটিসি ক্যাম্প, মাদ্রাসা ক্যাম্প, কনসাল ক্যাম্প ও কালাপানি বস্তি। এ ছাড়া রূপনগর এলাকায় মাদকের হটস্পট রহিমেন বস্তি। এসব ক্যাম্প ও বস্তিতে মাদক কারবারের প্রধান হোতা ১০ জন। তারা হলো শাহজাদী, আসলাম, সোহেল, পৃথিবী, রেসমা, নছেবা, পাগলা আজিজ, মাহফুজ, সালেহা ও মো. মাসুদ আলী। শীর্ষ কারবারিরা মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্প, আবদুল্লাহপুর ও টঙ্গী থেকে মাদক এনে পল্লবী ও রূপনগরে তাদের বিক্রয় কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেয়। ২৫ থেকে ৩০ জন বিক্রয়কর্মী সেই মাদক পুরো এলাকার সেবনকারীদের কাছে পৌঁছে দেয়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি মাদক বিকিকিনি হয় মিল্লাত ক্যাম্পে। বাংলা মদ, গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইনসহ সব ধরনের মাদক এখানে পাওয়া যায়। এই ক্যাম্পে মাদকের জোগান দেয় পৃথিবী, রেসমা, নছেবা। এদের হয়ে মাদক বিক্রি করে কালা মনুর বউ মুক্তা, সায়মা, শামিম, শমসের, শানজু। ওয়াপদা ভবন ১ থেকে ৪ পর্যন্ত প্রতিটিতেই চলে মাদক বিকিকিনি। এসব ভবনে মাদক বিক্রি করে কাছরা সানি, ল্যাংড়া রুবেল, রাসেল ও রুবেল দুই ভাই, অজয়, কাল্লু, লিটনের মা আর ছোট ভাই জাহিদ, শাম্মি সাকিলা, মাশাআলী, সনি, দুলারী।

এ ছাড়া পল্লবীতেই বাংলা মদের প্রায় হাফ ডজন স্পট রয়েছে। বাংলা মদের প্রধান জোগানদাতা পাগলা আজিজ ও মাহফুজ। তাদের হয়ে মদের স্পট পরিচালনা করে বাউনিয়াবাদ কাঁচাবাজারে আলি, বাউনিয়াবাদ পিকআপ স্ট্যান্ডে পাতা সোহেল, ১১/বি মিল্লাত ক্যাম্পে সিরাজ, এডিসি ক্যাম্পে নাসির। এ ছাড়াও সাংবাদিক আবাসিক এলাকার পেছনের স্পট চালায় জাহিদ। হেরোইন বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে এমসিসি ক্যাম্পে আফসার, মিল্লাত ক্যাম্পের দুই নম্বর রোডে জুম্মন, আনোয়ারী ও তার ছেলে ওয়াহীদ, ফুটবল ক্যাম্পে শমসের, বালুর মাঠ বাজারে শামিম, মিরপুর ১২ নম্বরের বেগম টিলা বস্তিতে আছিয়া ও তার মেয়ে। রূপনগরে মাদকের প্রধান হোতা সালেহা, বিপাশা ও মো. মাসুদ আলী।

এক পরিবারের সবাই মাদক কারবারি: বাউনিয়াবাদ এলাকার সবচেয়ে বড় মাদক কারবারি ফাতেমা বেগম ওরফে ফতু। তার বাবা বাবুল হোসেনও ছিল মাদক কারবারি। বাবা মারা যাওয়ার পর কারবারের হাল ধরে মেয়ে ফাতেমা। একে একে পুরো পরিবার মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ফতুর বিরুদ্ধেই মাদক ও ইয়াবা বিক্রির অভিযোগে ১৯টি মামলা রয়েছে। তার ভাই মামুনের বিরুদ্ধে ২০টি, আরেক ভাই খোকনের বিরুদ্ধে ১১টি, ভাইয়ের স্ত্রী মনির বিরুদ্ধে ৫টি মামলা রয়েছে। ফতুর স্বামী খোকনের বিরুদ্ধে ৩টি, ভাগনে অনিকের বিরুদ্ধে ৫টি, ফতুর মা হাসিনা বেগমের বিরুদ্ধে ৩টি, বোন পাতিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশকে মারধরের ঘটনায় ১টি এবং আরেক ভাইয়ের স্ত্রী রাবেয়ার বিরুদ্ধে ২টি মাদক মামলা রয়েছে। ফতুর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ৬৮টি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি এই ফতুকে ৪ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে মাত্র ৫শ পিস দেখিয়ে মামলা দেয় পল্লবী থানা পুলিশ। উপপরিদর্শক মো. আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে ফতুর দুই বোনের মধ্যকার দর কষাকষির একটি অডিও রেকর্ড আসে কালবেলার হাতে। এরপর ‘দুই লাখ টাকা দাও মাল কমিয়ে দেব’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হলে বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করে পুলিশ।

কালবেলার হাতে আরও একটি ভিডিও রয়েছে। এতে দেখা যায়, পল্লবী থানা পুলিশের উপপরিদর্শক ফয়সাল বলছেন, ‘আপনি যে টাকার কথা বলছেন, এত টাকা আমরা নিইনি। টাকা যে নিইনি এটা বললেও মিথ্যা কথা হবে ভাই।’ জানা যায়, একটি মাদক মামলা ছোট করতে ও গ্রেপ্তারের সময় জব্দ হওয়া গাড়ি ফেরত দিতে ভুক্তভোগীর পরিবার দুবারে পুলিশকে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা দেয়। সোর্স জালালের মাধ্যমে দেয় ৬০ হাজার এবং থানায় গিয়ে দেয় আরও ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ভুক্তভোগীর স্ত্রী সে সময় এ দাবি করে।

এর আগে পল্লবী থানার চতুর্থ তলায় পুলিশের ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে টিকটক করে আলোচনায় এসেছিল লাবলু নামে এক সোর্স। সে এসআই শুভর সোর্স হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া বাউনিয়াবাদের হোসেন মনির, মালেক, সোহাগ, হাবিব, স্বপন, নাসির, রাজিব, শাহিনুর, জুয়েল মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। বালুর মাঠ বস্তি এলাকায় মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত শাহানাজ, জন্টুর বউ, লাইলি, আঁখি ও হালিমা।

জানতে চাইলে বিহারি ক্যাম্পের সংগঠন স্ট্যান্ডেড পিপলস জেনারেল রিহ্যাবিলিটেশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সাধারণ সম্পাদক সায়েদ সাব্বির কালবেলাকে বলেন, আমরা তো আপ্রাণ চেষ্টা করছি মাদক বন্ধ করতে। কিন্তু পারছি না। আসলে পুলিশের কিছু কর্মকর্তার কারণে মাদক বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ যদি শতভাগ আন্তরিক হয়ে কাজ করত, তাহলে এটা বন্ধ করা যেত। পুলিশের কর্মকর্তারা মাদকের সঙ্গে জড়িত কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ, কিছু কর্মকর্তা আছে। কিন্তু সবাই নয়। ওই কিছু কর্মকর্তার জন্যই আসলে বন্ধ করা যাচ্ছে না। তারা মাদক কারবারিদের ধরে আবার ছেড়ে দেয়।

মাদক ব্যবসা কেন্দ্র করে এখানে প্রায়ই খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মাদকের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ, চুরি-ছিনতাই ক্যাম্প এলাকার নিত্যদিনের ঘটনা। অভিযোগ আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই চলে এখানকার মাদক ব্যবসা। বছরের পর বছর ধরে বিহারি ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা চলছে। দেখা যায়, বিভিন্ন সময় অভিযান হয়, কিন্তু ব্যবসা আর বন্ধ হয় না।

পল্লবী থানার দুই পরিদর্শকের মাসোহারার একটি তালিকাও এসেছে কালবেলার হাতে। তালিকাটি পল্লবী থানার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সূত্রে পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, এক পরিদর্শক ১২টি স্পট থেকে মাসে পান ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তার প্রধান লাইনম্যান ইমন নামের এক ব্যক্তি। আরেক পরিদর্শক ৪৫টি স্পট থেকে পান ৭ লাখ ২৯ হাজার টাকা। এই পরিদর্শকের টাকা তোলে ১৫ জন লাইনম্যান। যদিও মাসোহারার বিষয়টি দুই পরিদর্শকেই কালবেলার কাছে অস্বীকার করেছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে পল্লবী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) অপূর্ব হাসানকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) আরিফ আমিনুল কালবেলাকে বলেন, মাদকের সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। মাদকের বিরুদ্ধে সবসময়ই আমাদের জিরো টলারেন্স। এই এলাকায় নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে মিরপুর জোনের পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ক্যাম্পে গত সপ্তাহেই আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ছয়জনকে কারাদণ্ড দিয়েছি। আমরা আজ বা কালকের মধ্যেই আবারও অভিযান পরিচালনা করব।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মিরপুর জোনের উপকমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্লাকে ফোন দেওয়া হলে তিনি ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে ফোন কেটে দেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু মঞ্চ ও পোশাক কর্মশালা

এবার চতুর্থ সারির ক্লাবের কাছে হেরে ম্যানইউর বিদায়

ড. মাসুদের প্রচেষ্টায় দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেলো ৩ ইউনিয়নের মানুষ

বিশ্বকাপ দলে সুযোগ না পেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশ স্পিনার

রুমিন ফারহানার দুঃখ প্রকাশ

বৃহস্পতিবার প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা

ভারতে নিষিদ্ধ অনলাইন জুয়া, বড় ধাক্কায় আইপিএল ও ভারতীয় ক্রিকেট

পদক্ষেপ নিলে মনে হয় দেশেই থাকা হবে না : ডিসি মাসুদ

রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সভা

ডিআরইউতে মঞ্চ ৭১–এর কর্মসূচি প্রত্যাহারের দাবি

১০

জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব অপরিহার্য: উপদেষ্টা

১১

কনভেনশন হলে গেরিলা বৈঠকে গ্রেপ্তার শিমুল ৪ দিনের রিমান্ডে

১২

শাহবাগে এসে ডিএমপি কমিশনারের ‘দুঃখ প্রকাশ’

১৩

ইনকিলাব সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাল ছাত্রশিবির

১৪

বিএনপি নেতাকে কোপাল যুবলীগ নেতা

১৫

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হাটহাজারী বিমানবন্দর

১৬

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৭

ডাকসু নির্বাচন / ১৩২ শিক্ষার্থীকে খাওয়ালেন প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা বললেন আচরণবিধি লঙ্ঘন

১৮

সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে সিলেটে গণশুনানি

১৯

একাধিক উপকারিতা কাঠবাদামের, যাদের জন্য ক্ষতিকর

২০
X