অর্থাভাবে পঞ্চম শ্রেণির পর আর স্কুলে যেতে পারেননি তিনি। তাই নিরুপায় গোয়ালা বাবা ছেলেকে দই বেচার কাজ শুরু করতে বলেন। ইচ্ছা থাকলেও পড়ালেখা চালাতে না পারা সেই ব্যক্তির মনে বইয়ের প্রতি টান এতটুকুও কমেনি কখনো। কষ্টের অর্থে বই কিনে গড়ে তোলেন পাঠাগার। ঝরে পড়া ঠেকাতে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অকাতরে দিয়েছেন অর্থ, কিনে দিয়েছেন বই। সমাজের কল্যাণে সর্বদা থেকেছেন ব্রতী হয়ে। বিপদ-আপদে মানুষের পাশে থাকায় পেয়েছেন ‘সাদা মনের মানুষ’-এর খ্যাতি।
বলছিলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের বটতলার দই বিক্রেতা জিয়াউল হক জিয়ার কথা। সমাজসেবায় অবদানের জন্য গত মঙ্গলবার তাকে একুশে পদকে মনোনীত করা হয়েছে। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আইরিন ফারজানা তাকে তথ্যটি অবহিত করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তার সাধারণ মানুষ হয়েও অসাধারণ হয়ে ওঠা ও জীবনকর্মের কথা আলোচনায় এসেছে।
জিয়াউল হক ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন বটতলা গ্রামে। অর্থাভাবে ১৯৫৫ সালে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে আর হাইস্কুলে যেতে পারেননি তিনি। তার বাবা ছিলেন পেশায় একজন গোয়ালা।
তখন থেকে অর্থ ও বইয়ের অভাবে যেন তার মতো আর কারও পড়াশোনা বন্ধ না হয়, সেজন্য দই বিক্রির লাভের টাকার একটা অংশ জমিয়ে বই কিনে ওইসব শিক্ষার্থীকে পড়তে দিতেন জিয়া। এভাবেই তিনি এলাকার ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান। একজনের বই পড়া শেষ হলে বই নিয়ে দিতেন আরেকজনকে। দিনে দিনে তার ঘরে বইয়ের সংগ্রহ বাড়তে থাকে। পাঠ্যবইসহ অন্যান্য বই নিয়ে তাই তিনি গড়ে তোলেন ‘জিয়াউল হক সাধারণ গাঠাগার’। বর্তমানে এখানে ১৪ হাজার বই আছে।
পরে সরকার বিনামূল্যে স্কুলে বই বিতরণ শুরু করলে জিয়াউল কলেজ শিক্ষার্থীদের বই কিনে দিতেন। পড়াশোনায় অর্থ সহায়তা দিতে শুরু করেন। এ কাজে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বিত্তবান বিশেষত প্রবাসীরা তাকে অর্থসহায়তা করেন। সেই টাকা ও নিজের আয়ের অংশ দিয়ে শিক্ষা সহায়তার পাশাপাশি এলাকার দরিদ্রদের গৃহনির্মাণ, নলকূপ স্থাপন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সহায়তা ও ঈদ উপলক্ষে নতুন পোশাক দিয়ে সমাজসেবায় রেখেছেন অবদান। জানা যায়, ১৯৬০-২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি মানুষের মধ্যে ৩ কোটি ২৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছেন।
একুশে পদকের মনোনয়ন ঘোষণার পরদিনও জিয়াউল দই বিক্রি করতে যান ১০ কিলোমিটার দূরে রহনপুর বাজারে। যদিও এদিন শুভাকাঙ্ক্ষীরা আসেন তাকে শুভেচ্ছা, সংবর্ধনা জানাতে। এ পদকে ভূষিত হওয়ায় তাকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ও বহু প্রতিষ্ঠান অভিনন্দন জানিয়েছে।
রহনপুর বাজারে দই কেনার সময় মুর্শেদুল আলম মুসা নামে এক ক্রেতা জানান, আমরা তার কাছ থেকে দই কিনি। দইয়ের দাম একটু বেশি হলেও তার সমাজসেবায় সহায়তার জন্য কিনি।
পীরগাছা দারুস সুন্নাত দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মজিবুর রহমান জানান, তার বইয়ের সহায়তায় পড়াশোনা করে শিক্ষক হতে পেরেছি। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
মুশরীভুজা ইউসুফ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আজগার আলী বলেন, তার কলেজের অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী জিয়াউলের দেওয়া বই ও অর্থ সহায়তায় পড়াশোনা করছে। এমনকি তার সহায়তায় পড়াশোনা করা দুজন এখন এ কলেজের শিক্ষক।
জিয়াউলকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা স্কাউট। এর সম্পাদক আব্দুর রশিদ জানান, ‘একুশের পদক প্রাপ্তিতে দেশের গর্ব জিয়াউল হককে প্রাণঢালা অভিনন্দন। আমরা ইতিপূর্বেও তাকে আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সম্মাননা দিয়েছি।
ভোলাহাট উপজেলা চেয়ারম্যান রাব্বুল হোসেন বলেন, জিয়াউল হক আমাদের গর্ব, তাকে একুশে পদক দেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদৈর কৃতজ্ঞতা জানাই।
জিয়াউলের স্ত্রী ফরিদা বেগম জানান, আমি ধন্য এমন স্বামী পেয়েছি।
জিয়াউলের ছেলে মহব্বত হক বলেন, ‘আমার বাবার অবর্তমানে এগুলোর হাল ধরবো এবং এগিয়ে নিয়ে যাব।’
অনুভূতি জানিয়ে জিয়াউল বলেন, আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি যে, আমাকে একুশে পদ দেওয়া হবে। পদক পাওয়ায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত।