কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে অনেকটা অবহেলায় কেটে গেছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক মুনাফার দেড় দশক। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বাড়ানো যাচ্ছে না। এতে তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশই অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারছে না। কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না হলে জনমিতিক মুনাফার বাকি সময়ও নিষ্ফল কেটে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
কোনো দেশে নির্ভরশীল জনসংখ্যার তুলনায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি হলে তাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক মুনাফা বলা হয়। দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি কর্মক্ষম (১৫-৬৪ বছর) হলে ওই দেশ জনমিতিক মুনাফাকালে রয়েছে বলে ধরা হয়।
বাংলাদেশের জনমিতিক মুনাফার সময় শুরু হয় ২০০৭ সালে। সেই সময় জনসংখ্যার ৬১.৪ শতাংশ ছিল কর্মক্ষম। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ‘বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন ২০২৩’ বলছে, বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ১০ কোটি ৫০ লাখ বা ৬২ শতাংশ কর্মক্ষম, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। জনসংখ্যার ২৮ শতাংশই আবার ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী। ফলে জনমিতিক হিসেবে সবচেয়ে সম্ভাবনায় সময় পার করছে বাংলাদেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের জনসংখ্যায় তারুণ্যের সুবিধাজনক এই পরিস্থিতিত আগামী ২০৩৮ সাল পর্যন্ত থাকবে। এরপর ধীরে ধীরে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, জনমিতিক মুনাফা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছিল। কারণ এ দেশের গড় আয়ুষ্কাল বাড়ছে। আবার অন্যদিক থেকে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনো কিশোর বা তরুণ। এই সময়ে সমাজে কর্মক্ষম মানুষ বাড়তে থাকে এবং নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা কমতে থাকে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এটা একটা বড় সুযোগের জানালা খুলে দেয়। এই সময়ে যদি দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা যায়—যাদের উৎপাদনশীলতা বেশি থাকবে, যারা অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আনতে পারবে, এটাই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। এই সময়ে যদি দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে এরপর যখন বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে অর্থনীতি তখন সমস্যার মধ্যে পড়বে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসংখ্যার তারুণ্যনির্ভরতা প্রতিটি দেশের জন্য একবার করে আসে। এই সুবিধাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি দেশের অর্থনীতি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। জনমিতিক মুনাফার সুযোগ কাজে লাগিয়েই জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ানসহ অনেক দেশ অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করেছে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষকে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছার শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মাঈনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যায় তারুণ্যের সংখ্যা বেশি। কিন্তু সংখ্যায় বেশি থাকা মানেই আপনি এর সুফল পেয়ে যাবেন, তা নয়। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। এই তারুণ্যকে সুস্বাস্ব্যবান হতে হবে। প্রশিক্ষিত তারুণ্য হতে হবে। তা না হলে এরা অর্থনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমবাজারে যদি কাজের নিশ্চয়তা না দেওয়া যায়, তাহলে সেটা উল্টো বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো দেশ জনমিতিক মুনাফায় প্রবেশের আগেই এই সুবিধা কাজে লাগানোর প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু ২০০৭ সালের আগে বাংলাদেশ এ বিষয়ে দূরদর্শী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এ কারণে বর্তমানে তরুণদের জন্য চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে ২৬ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সম্পূর্ণ বেকার। আর ২০১৯ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) প্রকাশিত ‘কর্মসংস্থান, উৎপাদনশীলতা এবং খাতভিত্তিক বিনিয়োগ সমীক্ষা’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাগজে-কলমে বেকার না হলেও যোগ্যতা কিংবা চাহিদা অনুযায়ী কাজ ও মজুরি পায় না ১ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জনসংখ্যার বিদ্যমান সুবিধা কাজে লাগাতে হলে কর্মক্ষম মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সে অনুযায়ী সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য দরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় অঙ্কের সরকারি বিনিয়োগ। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক মুনাফায় প্রবেশের সময় সিঙ্গাপুর ও জাপানের মতো দেশগুলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলায় গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যয় করে। কিন্তু গত ১০ বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যয় করছে ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। এই বরাদ্দও মানসম্মতভাবে ব্যয় হচ্ছে না। শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণ হলেও মানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। ফলে একটি বড় অংশই শিক্ষিত হয়েও অদক্ষই থেকে যাচ্ছে। এদের অনেকে দেশে-বিদেশে কাজে যুক্ত হলেও তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ও আয় আসছে না।
পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ কাজ করছে। গত অর্থবছরে তাদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। প্রায় সমানসংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি করে পাকিস্তানের রেমিট্যান্স আয় প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলার। আর বিভিন্ন দেশে কর্মরত ১ কোটি ৮০ লাখ ভারতীয় বছরে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি ডলার। বেশিরভাগ বাংলাদেশি কোনো দক্ষতা ছাড়াই বিদেশে কাজ করতে যাওয়ায় তারা উচ্চ মজুরির কাজে যুক্ত হতে পারেন না।
গত এক দশকে বাংলাদেশে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে তা কর্মক্ষম মানুষের চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। আবার মোট কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২৮ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। এক দশকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে তা এক রকম স্থবির হয়ে আছে। গত চার অর্থবছরে ধরে এই হার জিডিপির ২৩ থেকে ২৪ শতাংশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক মুনাফার সুযোগ কাজে লাগাতে হলে অর্থনীতিতে পরিকল্পিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে ইউনেস্কোর পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা খাতে বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষার প্রতি সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চাহিদার ভিত্তিতে দক্ষ জনশক্তি গড়তে হবে। দেশের মানুষের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সবার জন্য আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জন্য এই সুযোগের এরই মধ্যে ১৫ বছর চলে গেছে। আরও হয়তো ১৫-২০ বছর থাকবে। কিন্তু জনমিতিক মুনাফার সুযোগ নেওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল, সেটা কিন্তু পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি। জনমিতির মুনাফার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের পরিকল্পনা ছিল। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রতিটি পরিকল্পনায়ই এটা আলাদাভাবে উল্লেখ করা আছে—কী কী করা হবে বা কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি।
এ অবস্থায় করণীয় জানতে চাইলে ড. মোস্তাফিজ বলেন, জনমিতিক মুনাফা কাজে লাগানোর জন্য প্রথম কাজ হচ্ছে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা। এখানে দুর্বলতা থাকলে পরে আর তা কাঠিয়ে ওঠা যায় না। দ্বিতীয়ত, ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ছিল অষ্টম শ্রেণির পরই বৃত্তিমূলক শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া। কিন্তু সেটাও বাস্তবায়ন করা যায়নি। তৃতীয়ত, দেশে যে ধরনের কারিগরি শিক্ষার যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেটা বাজারের চাহিদার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই বড় পার্থক্য দেখা যায়। এসব জায়গায় বাজারের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এটা করতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিল্পের সংযোগ বাড়াতে হবে। শিক্ষানবিশিকে উৎসাহিত করার জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। যেসব দেশ জনমিতিক মুনাফা বেশি নিতে পেরেছে তারা কিন্তু এই শিক্ষানবিশি কার্যক্রমকে প্রণোদিত করেছে।
মন্তব্য করুন