রাজধানীর দারুস সালাম এলাকার বাসিন্দা স্বাধীন মিয়া। সাত বছর আগে কিডনি সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা যায়, তার দুটি কিডনি বিকল হওয়ার পথে। সঞ্চয়ের সামান্য টাকায় ওষুধের মধ্যদিয়ে শুরু হয় চিকিৎসা। দুই বছরের মধ্যে বাড়তে থাকে শারীরিক জটিলতা। ২০১৯ সালে তার দুটি কিডনি বিকল হয়ে যায়। ফলে কিডনি প্রতিস্থাপন কিংবা ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন দেখা দেয়। তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তির এমন অচলাবস্থায় সংসারে অন্ধকার নেমে আসে। আইনি জটিলতা ও অর্থাভাবে সম্ভব হয়নি কিডনি প্রতিস্থাপন। শুরু হয় ডায়ালাইসিস চিকিৎসা। পাঁচ বছর ধরে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে পরিবারটি নিঃস্ব।
২০১৯ সালে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে তার ডায়ালাইসিস শুরু হয়। তখন ৩৭৫ টাকায় মিলত ডায়ালাইসিস। বর্তমানে এই কেন্দ্রে সরকারি সুবিধায় ডায়ালাইসিস করা রোগীর দিতে হয় ৫৩৫ টাকা। আর সরকার ভর্তুকি দেয় ২ হাজার ৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে খরচ হয় ৩ হাজার ১০০ টাকা। সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতে হয় স্বাধীন মিয়ার। ভর্তুকি মূল্যে একজন রোগী সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুটি ডায়ালাইসিস পেতে পারেন। সেই হিসেবে স্বাধীন মিয়া সপ্তাহে দুটি ডায়ালাইসিস করাতে পারেন ১ হাজার ৭০ টাকায়। আর একটি নিজ খরচে করতে হয় ৩ হাজার ১০০ টাকা। উপার্জনের ক্ষমতা হারালেও প্রতি মাসে ডায়ালাইসিস, ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অন্যান্য কাজে তার পেছনে খরচ হয় গড়ে ৫০ হাজার টাকা।
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মূল ভবনের চতুর্থ তলায় রয়েছে স্যানডোর ডায়ালাইসিস সার্ভিসেস বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড। আন্তর্জাতিক দরপত্রে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যানডোর এই সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ২০২৭ সাল পর্যন্ত দরপত্রের মেয়াদ রয়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও রয়েছে স্যানডোর ডায়ালাইসিস।
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে বর্তমানে ৫৯টি ডায়ালাইসিস মেশিন রয়েছে। গত মঙ্গলবার সরেজমিন ইনস্টিটিউটের মূল ভবনের চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেন্টারের কাউন্টারে রোগী ও স্বজনদের অপেক্ষার প্রহর। সিরিয়ালে থাকা স্বাধীন মিয়া ও তার স্ত্রী শামসুন নাহারের সঙ্গে কথা হয় সেখানে। কিডনির ব্যথায় কথা বলতে পারছেন না স্বাধীন মিয়া। কথা হয় তার স্ত্রী শামসুন নাহারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘরের কর্মক্ষম মানুষ অসুস্থ হওয়ায় আমরা খুবই বিপাকে আছি। চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। টিউশনি ও কিছু হাতের কাজ করে যে টাকা পাই, তা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা ও সংসার চালাই। এভাবে আর কতদিন চলতে পারব জানি না।
শামসুন নাহারের মতো একই প্রশ্ন লালবাগের বাসিন্দা ইমরান হোসেনের। তার চাচা আইয়ুব আলী মাদবরের মাসে ছয়টি ডায়ালাইসিস করাতে হয়। ২০ হাজার টাকা এককালীন পরিশোধ করেছেন তারা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারি ভর্তুকি মূল্যে প্রতি ডায়ালাইসিস ৫৩৫ টাকায় করাতে পারলেও কতদিন ব্যয় বহন করা সম্ভব? বিষয়টি নিয়ে তারাও চিন্তিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকার স্যানডোর পরিচালিত কেন্দ্রে বর্তমানে নতুন রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পাচ্ছেন না। চার শিফটে ২৪ ঘণ্টা ডায়ালাইসিস চলে এই হাসপাতালে। দিনে ২৩৬ জনের ডায়ালাইসিসের সক্ষমতা থাকলেও ২০২৭ সাল পর্যন্ত গড়ে ১১৫ থেকে ১২০ জন পুরোনো রোগীকে স্বল্পমূল্যে ডায়ালাইসিস করবে স্যানডোর। দরপত্রের শর্তানুযায়ী বছরে ১৯ হাজার সেশন পরিচালনা করার কথা। প্রতি চার ঘণ্টার ডায়ালাইসিসকে একটি সেশন ধরা হয়। সেই হিসেবে গত বছরও স্যানডোর হাসপাতালটি ৪২ হাজার সেশন পরিচালনা করেছে।
স্যানডোর ডায়ালাইসিস সিস্টেমের কনসালট্যান্ট ডা. কেইউএম শামসুন নাহার বলেন, কভিডকালে আমরা এক বছরে ৯৬ হাজার সেশনও পরিচালনা করেছি। চুক্তি অনুযায়ী স্যানডোর ২০২৭ সাল পর্যন্ত বছরে ১৯ হাজার সেশন ডায়ালাইসিস সেবা প্রদান করার কথা। কিন্তু মানবিক কারণে আমরা গত বছরও ৪২ হাজার সেশন ডায়ালাইসিস দিয়েছি। তবে নতুন রোগী যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ শেষে সরকার যদি নতুন করে সেবার পরিধি বাড়ায়, তাহলে নতুন রোগীরা সুযোগ পাবেন। তবে নিজ খরচে কেউ ডায়ালাইসিস করাতে চাইলে স্যানডোর সেই সেবা দিয়ে থাকে।
দেশে কতজন কিডনি রোগী আছেন—এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন মডেল সার্ভের তথ্যমতে, সারা দেশে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কিডনি রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল বা অকার্যকর। প্রতি বছর অন্তত ৫০ হাজার নতুন কিডনি রোগী যুক্ত হয়। কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়েনি সেবার পরিধি। দেশে বর্তমানে মাত্র ১৪০টি সরকারি ও বেসরকারি ডায়ালাইসিস সেন্টার রয়েছে। অন্যদিকে, আইনি জটিলতায় গতি নেই কিডনি প্রতিস্থাপনেও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিডনি রোগীর চিকিৎসা হয় ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপন এ দুইভাবে। দুই ধরনের চিকিৎসাই ব্যয়বহুল। এ কারণে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীই বিনা চিকিৎসায় অথবা আংশিক চিকিৎসায় মারা যান। ঢাকায় সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও ব্যক্তি মালিকানায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কয়েকটি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে উঠেছে। ঢাকার বাইরে বড় কয়েকটি শহরে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে সীমিত পর্যায়ে এই চিকিৎসাসেবা আছে। তবে বেশিরভাগ জেলায় কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা সেভাবে নেই।
চিকিৎসকরা বলছেন, ৮০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে কিডনি জটিলতার জন্য দায়ী ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও নেফ্রাইটিস (কিডনির বিভিন্ন সমস্যা)। অন্য রোগের প্রভাবে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বা আরও বেশি মানুষের কিডনির নানা সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ডায়াবেটিসের কারণে এবং ১০ থেকে ২০ শতাংশ কিডনি বিকল হয় উচ্চ রক্তচাপের কারণে। এ ছাড়া বংশগত কারণ, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাল সংক্রমণে কিডনিতে পাথর, অস্বাস্থ্যকর ডায়েট এবং ওষুধের প্রভাবেও কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে সচেতন হলেই ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিডনি বিকল হওয়া থেকে রোধ করা সম্ভব বলে জানান চিকিৎসকরা।
ডা. আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ বলেন, সরকারিভাবে কিডনি ডায়ালাইসিসের সুযোগ আছে মাত্র ১২ থেকে ১৬ শতাংশ রোগীর। চিকিৎসায় কিডনি রোগের সমাধান মিলবে না। এজন্য প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। বয়স ৪০ বছর হলেই প্রত্যেকেরই বছরে অন্তত দুৎবার কিডনি পরীক্ষা করা দরকার।
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, সারা দেশে এখন ৪০০টি ডায়ালাইসিস বেড চালু রয়েছে। শুধু ডায়ালাইসিস কোনো সমাধান নয়। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে পুরো পরিবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। আমাদের কিডনি রোগ প্রতিরোধে জোর দিতে হবে।
কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা সম্প্রসারণ প্রকল্প স্থবির: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে সরকার ঘোষণা করেছিল দেশের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে ডায়ালাইসিস ও কিডনি চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেবে। এ লক্ষ্যে ৪৪ জেলা সদর হাসপাতালে ১০ বেডের এবং ২২টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ বেডের ডায়ালাইসিস সেন্টার প্রতিস্থাপন প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। বলেছিল, প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রতিদিন তিন শিফটে প্রায় সাড়ে চার হাজার রোগী ডায়ালাইসিস সেবা পাবেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও সেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি।
প্রকল্পের সদ্য সাবেক পরিচালক মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফিজিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আরিফুর রহমান বলেন, আট বিভাগে ক্যান্সার, কিডনি ও হৃদরোগের সমন্বিত হাসপাতালের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পেরও কাজের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। জেলা সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়ালাইসিস শয্যা বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামোর কাজও শেষ হয়েছে। বাকি কাজ নতুন প্রকল্প পরিচালকের হাত ধরে শিগগিরই শেষ হবে।
বিশ্ব কিডনি দিবস ও কর্মসূচি: প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মার্চ মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার বিশ্ব কিডনি দিবস উদযাপন করা হয়ে থাকে। সেই হিসেবে আজ দিবসটি উদযাপন হবে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘সুস্থ কিডনি সবার জন্য-বৃদ্ধি পাচ্ছে ন্যায়সংগত সেবার সমান সুযোগ আর নিরাপদ ও সর্বোত্তম ওষুধের অনুশীলন’। সরকারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট, কিডনি ফাউন্ডেশন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন, ক্যাম্পসসহ বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে।